ভ্যাটের মেশিন বসলে ভ্যাট আদায় যেমন বাড়বে, তেমনি আয়কর আদায়ও বাড়বে। নতুন উদ্যোগে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে সারা দেশে প্রায় সব দোকানপাটে ভ্যাটের মেশিন বসে যাবে। কারণ, এবার ভ্যাটের মেশিন কিনতে ব্যবসায়ীদের পয়সা দিতে হবে না।মইনুল খান, সদস্য, এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ
ইএফডি নিয়ে নতুন উদ্যোগ
চলতি অর্থবছরের শুরুতে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ নতুন আরেক উদ্যোগ নেয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে আগামী পাঁচ বছরে তিন লাখ ইএফডি বসানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিনা মূল্যে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানে ইএফডি মেশিন বসাবে। বিনিময়ে প্রতি ১০০ টাকা ভ্যাটে ৫২ পয়সা কমিশন হিসেবে পাবে।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই জেনেক্স ইনফোসিসের দুই হাজার ভ্যাট মেশিনের চালান আসছে। আর চলতি অর্থবছরের প্রায় ২০ হাজার মেশিন বসানোর লক্ষ্য রয়েছে। বড় বড় শহরের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেশ ভালো, এমন উপজেলা সদরের দোকানপাটেও আগামী পাঁচ বছরে ভ্যাটের মেশিন বসানো হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের সদস্য মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, ভ্যাটের মেশিন বসলে ভ্যাট আদায় যেমন বাড়বে, তেমনি আয়কর আদায়ও বাড়বে। নতুন উদ্যোগে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে সারা দেশে প্রায় সব দোকানপাটে ভ্যাটের মেশিন বসে যাবে। কারণ, এবার ভ্যাটের মেশিন কিনতে ব্যবসায়ীদের পয়সা দিতে হবে না।
মইনুল খান জানান, একই বিপণিবিতানের সব দোকানে একসঙ্গে এই মেশিন বসানো হবে। ভ্যাটের মেশিনে এমনভাবে সফটওয়্যার থাকবে, মাস শেষে এক ক্লিকেই ভ্যাটের রিটার্নও জমা দিতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের তিন দাবি
ইএফডি মেশিনের বিপক্ষে নন খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। গত বাজেটের আগে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ইএফডি মেশিন নিয়ে তিনটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
প্রথমত, ভ্যাটের মেশিন বিচ্ছিন্নভাবে বসানো নয়; যখন যে খাতে বসানো হবে, সে খাতের সব প্রতিষ্ঠানে বসাতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিক্রেতার কাছ থেকে ২-৩ শতাংশ উৎসে ভ্যাট নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি ভ্যাট না নেওয়া। যুক্তি ছিল, পণ্যের দামে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকলে ভোক্তা ভ্যাটের চাপ টের পাবেন না। তৃতীয়ত, টানা তিন-বছর ব্যাপকভাবে মাঠপর্যায়ে ভ্যাট মেশিন বসানোর কার্যক্রম পরিচালনা করা।
গত বাজেটের আগে এই প্রস্তাব দেওয়ার পর এগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখার জন্য তৎকালীন ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রধান আবদুর রউফকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ওই কমিটির প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন ভ্যাট কর্মকর্তারা ২০-২৫টি মেশিন নিয়ে বাজার বা মার্কেটে আসেন। সবাইকে মেশিন দিতে পারেন না তাঁরা। ফলে যাঁদের মেশিন দেওয়া হয়, তাঁরা বিপদে পড়ে যান। ভ্যাট দিতে হয় বলে গ্রাহকেরা তাঁদের দোকানে যেতে চান না।’
লটারির সুফল মিলছে না
ইএফডি মেশিনের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা কিনলে মাস শেষে লটারি হয়। লটারিতে জিতলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ আছে। ভ্যাটের মেশিন থেকে পাওয়া রসিদের নম্বর দিয়ে এই লটারি হয়। মূলত ইএফডি মেশিন আছে, এমন দোকান থেকে কেনাকাটাকে উৎসাহিত করতেই এনবিআর এই উদ্যোগ নেয়।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে লটারি শুরু হয়। গত দুই বছরে লটারি নিয়ে ক্রেতাদের তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই বছরে মাত্র তিনবার প্রথম পুরস্কার বিজয়ীর দাবিদার পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ৩০ শতাংশ পুরস্কার বিজয়ীরও খোঁজ মেলে না। কেউ পুরস্কারের দাবি নিয়ে আসেনি। অথচ প্রতি মাসে ১০১ জনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ইএফডি মেশিন আছে, এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে সব মিলিয়ে প্রতি মাস ৩০-৩৫ কোটি টাকার ভ্যাট পায় রাজস্ব কর্তৃপক্ষ।
তবে ইএফডির রসিদ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় দেখা গেছে যে একজন ক্রেতা হয়তো পণ্য কিনছেন, কিন্তু ইএফডি থেকে রসিদ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। রসিদ নেওয়া মানে, সরকারের কোষাগারে ভ্যাট জমা পড়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া।
কেন অনেকে রসিদ নিতে আগ্রহী হন না, এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে ভ্যাটের রসিদ দিলে বেশি দাম পড়বে, অনেক দোকানদার এমন কথা বলে ক্রেতাকে রসিদ নিতে নিরুৎসাহিত করেন। আবার অনেক গ্রাহক নিজেও ভ্যাটের রসিদ চান না।
কর্মকর্তারা মনে করেন, মানুষ সচেতন হয়ে ইএফডি রসিদ সংগ্রহ করলে তাদের পরিশোধ করা ভ্যাট সরকারের কোষাগারে জমা হওয়া নিশ্চিত হবে।