সোনার দাম কমা-বাড়ায় কার লাভ, কার ক্ষতি

দেশের বাজারে সোনার ভরি এখন ১ লাখ ৮ হাজার ১২৫ টাকা। ২০ বছর আগেও এক ভরি সোনা ৯ হাজার ৪০১ টাকায় কেনা যেত। তার মানে দুই দশকে দামি এই ধাতুটির দাম ভরিতে বেড়েছে প্রায় লাখ টাকা। এর মধ্যে গত তিন বছরেই দাম বেড়েছে ৩২ হাজার ৬৫৯ টাকা।

সোনার দাম হু হু করে বাড়তে থাকায় ক্রেতাদের মধ্যে যাঁরা অলংকার তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন তাঁরা আছেন দুশ্চিন্তায়। কারণ, সোনার অলংকার দিন দিন তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চমূল্যের কারণে ক্রেতা কমে যাওয়ায় জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন।

অবশ্য মুদ্রার উল্টো পিঠও রয়েছে, যেখানে দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরোনো সোনা কিংবা অলংকারের সম্পদমূল্য বেড়েছে। ফলে যাঁদের সিন্দুকে গচ্ছিত পুরোনো অলংকার রয়েছে, তাঁরা দাম কতটুকু বাড়ল, সেই হিসাব করছেন। দাম আরও বাড়বে কি না সেই খোঁজখবর নিচ্ছেন। একইভাবে সোনার দাম বাড়লে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদেরও সম্পদমূল্য বৃদ্ধি পায়। অবশ্য দাম কমলে তাঁদেরও লোকসান হয়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সোনার দাম বাড়ে। সে জন্য সামর্থ্য থাকলে সোনা কিংবা অলংকারে বিনিয়োগ করেন অনেকে। যদিও সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমে গেছে।
ইসলাম দেওয়ান আমিনুল, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সহসভাপতি

চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে জানুয়ারি-নভেম্বরে দেশের বাজারে ২৭ বার সোনার দাম সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। এর মধ্যে দাম কমানো হয়েছে ১১ বার, আর বাড়ানো হয়েছে ১৬ বার। গত জানুয়ারিতে হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। ২১ জুলাই দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো প্রতি ভরি সোনার দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। তারপর গত ৩০ নভেম্বর সোনার দাম ১ লাখ ৯ হাজার ৮৭৫ টাকায় পৌঁছায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত ৭ ডিসেম্বর ভরিপ্রতি দাম অবশ্য ১ হাজার ৭৫০ টাকা কমে।

সোনার দাম কখন বাড়ে

সোনার দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে সোনার বাজারে সুদিন। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি সোনার মূল্যবৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সোনার দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেটিই ছিল এত দিন ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম। কিন্তু গত ১ ডিসেম্বর সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায়, মানে আউন্সপ্রতি সোনার দাম ২ হাজার ৭২ ডলারে উঠেছে।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পরে দুই মাস ধরে সোনার দাম বেড়েছে। গত মাসে সাত দিনের যুদ্ধবিরতি শেষে ১ ডিসেম্বর আবারও ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ওই দিন প্রতি আউন্স সোনার দাম একলাফে ৩২ ডলার বৃদ্ধি পায়। যদিও তারপর দাম কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বের ২৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমবর্ধমান মার্কিন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে হতাশায় রয়েছে। এ কারণে তারা আগামী এক বছরের মধ্যে সোনার রিজার্ভ বাড়াতে চায়। এর ফলে আগামী বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক খাত থেকেই সোনার জন্য উচ্চ চাহিদা থাকবে।

সোনার দামের সঙ্গে চাহিদা ও জোগানের সম্পর্ক আছে। সোনার চাহিদা মূলত দুইভাবে তৈরি হয়। যেমন গয়নার চাহিদা ও সোনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। গয়না হিসেবে সোনা বেশি ব্যবহার করা হয় চীন ও ভারতে। পশ্চিমা দেশগুলোয়ও গয়নার ভালো চাহিদা আছে। চাহিদার মতো সরবরাহও নিশ্চিত হয় দুইভাবে—খনি থেকে নতুন উত্তোলন এবং পুরোনো সোনা বিক্রি। যদিও স্বর্ণখনি থেকে সোনা উত্তোলন একটি চলমান প্রক্রিয়া।

আন্তর্জাতিক গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে, গত ২০২২ সালে খনি থেকে ৩ হাজার ৬২৪ টন সোনা উত্তোলন হয়। আর পুরোনো সোনা থেকে পাওয়া যায় ১ হাজার ১৪০ টন। অন্যদিকে গয়না তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ২ হাজার ১৯৫ টন সোনা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ১১৩ টন। আর বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ হাজার ৮২ টন সোনার বার ও মুদ্রায় বিনিয়োগ করেছে।

বিশ্বজুড়ে সোনার বিপুল চাহিদা ও জোগানের ভিড়ে বাংলাদেশের বাজার খুবই ছোট। এখানে সুনির্দিষ্ট হিসাবও নেই। তবে মনে করা হয়, দেশে বছরে ২০-৪০ টন সোনার চাহিদা রয়েছে। এর মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পুরোনো অলংকার দিয়ে। বাকিটা ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আসে। অবৈধভাবেও প্রচুর সোনা আসে। জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফেরাতে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হয়। শুরুতে কিছু আমদানি হলেও নানা জটিলতায় পরে তা শ্লথ হয়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জুয়েলারি ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, বৈধ পথে আমদানি না হওয়ায় বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে সোনার দাম কিছুটা বেশি।

কার লাভ, কার ক্ষতি

বাংলাদেশ যে বছর স্বাধীন হয়, তার আগের বছর সোনার ভরি ছিল ১৫৪ টাকা। তার মানে গত ৫২ বছরে দাম বেড়েছে ৭০২ গুণ। দীর্ঘ এ সময়ে পুরোনো সোনার অলংকারের দামও আনুপাতিক হারে বেড়েছে।

সাধারণত পুরোনো অলংকার জুয়েলার্সে বিক্রি করতে গেলে তারা ওজন করার পর তা কোন ক্যারেটের সোনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়। তারপর অলংকারটির বর্তমান ওজন থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করে।

ধরা যাক, কারও কাছে ২০০৫ সালে ১৩ হাজার ৮৩৩ টাকা ভরিতে কেনা ২২ ক্যারেটের এক ভরির সোনার অলংকার রয়েছে। সেটি বিক্রি করতে গেলে তিনি বর্তমানে ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা পাবেন। তাতে মুনাফা দাঁড়ায় ৭২ হাজার ৬৬৭ টাকা। ২১ ও ১৮ ক্যারেটের অলংকার হলে মুনাফা কিছুটা ভিন্ন হবে।

একইভাবে সোনার দাম বাড়লে জুয়েলার্স ব্যবসায়ীদের লাভ হয়। ধরা যাক, গত জানুয়ারিতে একজন ব্যবসায়ী ২২ ক্যারেটের এক ভরির একটি অলংকার তৈরি করেন। তখন সোনার ভরি ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। এখন সেই অলংকার বিক্রি করলে শুধু সোনার দামই বেশি পাবেন ১৯ হাজার ৭১২ টাকা।

এদিকে বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানের মালিক ও কর্মীরা জানান, সোনার দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় অলংকার তৈরির ক্রয়াদেশ কমেছে। এ কারণে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের স্বর্ণশিল্পীদের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। সেখানে গত দুই দশকের ব্যবধানে স্বর্ণশিল্পীদের সংখ্যা কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে বলে দাবি করেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সোনার দাম বাড়ে। সে জন্য সামর্থ্য থাকলে সোনা কিংবা অলংকারে বিনিয়োগ করেন অনেকে। যদিও সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমে গেছে। তারপরও ব্যবসায়ীরা যেহেতু টিকে আছেন, সেহেতু ব্যবসা কিছু না কিছু হচ্ছে বলা যায়। তবে স্বর্ণশিল্পীর সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে যাঁরা আছেন, তাঁদের আয় কমেনি। এর কারণ সোনার দাম বেড়েছে।