বাড়তি দামের সোনা কিনছে কারা

বৈশ্বিক বাজারে সোনার দাম নিয়ে অস্থিরতা চলছেই। দেশেও তার আঁচ লেগেছে, ভরি দুই লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সামনের দিনে দাম আর কত বাড়বে, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। শিগগিরই সোনার দাম কমার লক্ষণ কম। ছয় মাস বা এক বছরের আগের দামে আবার এই ধাতু ফিরবে কি না, সেটিও এখন বড় প্রশ্ন।

এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন, আকাশচুম্বী দামে সোনা কিনছে কারা? দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দুনিয়াজুড়ে সোনার অলংকারের চাহিদা কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে সোনায় লগ্নি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আবার মজুত বাড়াতে সোনা কেনা অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বে ৪ হাজার ৯৪৬ টন সোনা সরবরাহ করা হয়। গত বছর সেটি বেড়ে হয় ৪ হাজার ৯৭৫ টন। এর মধ্যে খনি থেকে উত্তোলিত হয়ে এসেছে ৩ হাজার ৬৬১ টন সোনা। আর ১ হাজার ৩৭০ টন পুরোনো সোনা পুনরুৎপাদন করে পাওয়া গেছে।

সোনার দামের সঙ্গে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও যুদ্ধের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সোজা বাংলায় বললে, দুর্দিনে সোনার দাম বাড়ে। বিষয়টি বোঝার জন্য বেশি দিন পেছনে যাওয়ার দরকার নেই, করোনাকালে যখন দেশে দেশে অর্থনীতি বিপর্যস্ত, প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক, সাধারণ মানুষের আয় কমছে, প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী, তখনই সোনার দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আবার যখন রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরু হয়, তখনো সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। গত শুক্রবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও সোনার দাম বেড়েই চলেছে।

বিশ্ববাজারে গত সোমবার একপর্যায়ে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৪ হাজার ১০০ ডলারে পৌঁছায়। করোনাকালে ২০২০ সালের মধ্য অক্টোবরে সোনার দাম ছিল আউন্স প্রতি ১ হাজার ৯০০ ডলার। তার মানে পাঁচ বছরের ব্যবধানে সোনার দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস এক পূর্বাভাসে বলেছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৪ হাজার ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। এদিকে ব্যাংক অব আমেরিকা গ্লোবাল রিসার্চ পূর্বাভাস দিয়েছে, আগামী বছর প্রতি আউন্স সোনার দাম পাঁচ হাজার ডলারে পৌঁছাবে।

বিশ্ববাজারের প্রভাবে দেশেও সোনার দাম বাড়ছে দফায় দফায়। গতকাল ভরিপ্রতি সোনার দাম বেড়েছে ৪ হাজার ৬১৮ টাকা। তাতে এক ভরি সোনার দাম বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার টাকায়। গত মাসেই দেশে দাম বেড়েছে ভরিপ্রতি ৩০ হাজার টাকা।

সোনার দাম কেন বাড়ে

যেকোনো পণ্যের দামের ওঠানামা নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপর। তবে সোনার ক্ষেত্রে যোগ হয় ভোক্তার আচরণ। কেউ যদি মনে করেন সামনে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, তাহলে কিন্তু অর্থের ওপর ভরসা কমে যায়। কারণ, মূল্যস্ফীতি বাড়লে অর্থের মূল্যমান হ্রাস পায়। তখন মনে করা হয়, এমন কিছু পণ্য কিনে রাখতে হবে, যার ক্ষয় নেই। এমন নয় যে বছর বছর সোনার খনি থেকে সোনার সরবরাহ বাড়তে থাকে। সুতরাং এখানে চাহিদা-জোগানের চেয়ে ভোক্তার আচরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

চলতি বছরের গোড়ার দিকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ২ হাজার ৬২৪ ডলার। গতকাল একপর্যায়ে সোনার দাম উঠে ৪ হাজার ১০০ ডলার। তার মানে চলতি বছর এখন পর্যন্ত সোনার দাম বেড়েছে ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

১০ মাসের ব্যবধানে সোনার এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বিশ্লেষকেরা অনেকগুলো কারণকে সামনে আনছেন। এর মধ্যে রয়েছে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা বাড়িয়েছে। বাণিজ্যযুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনাকে বেছে নিচ্ছেন। ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার এক-চতুর্থাংশ পয়েন্ট কমাতে পারে, এমন আশঙ্কাতে নতুন করে সোনার দাম বাড়ছে।

দামি সোনা কিনছে কারা

বিশ্ববাজারে প্রতিবছর যে পরিমাণ সোনার জোগান মিলে তার বড় অংশ অলংকারে ব্যবহার করা হয়। তবে সোনার দাম বাড়তে থাকায় অলংকারে এটির ব্যবহার কিছুটা কমছে। অন্যদিকে সোনায় বিনিয়োগকারীদের লগ্নি বাড়ছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে সোনার চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৩৬০ টন। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ বা ২ হাজার ৪৭৯ টন অলংকার ও ৩৩৮ টন প্রযুক্তিপণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন ৯৬৩ টন। আর বিভিন্ন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ বাড়াতে কিনেছে ৫৭৯ টন সোনা। গত বছর সোনার চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৬৭৫ টন। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ বা ২ হাজার ২৭ টন অলংকার ও ৩২৬ টন প্রযুক্তিপণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে। ১ হাজার ১৮২ টন কিনেছেন বিনিয়োগকারীরা। আর ১ হাজার ৮৯ টন কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অবশ্য চলতি বছরের প্রথমার্ধে সোনায় লগ্নি বাড়িয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। গত জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে জুয়েলারি তৈরির জন্য ৭৮২ টন সোনা ব্যবহৃত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা কিনেছেন ১ হাজার ২৮ টন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪১২ টন সোনা কিনে মজুত করেছে। অথচ গত বছরের শেষ ছয় মাসে অলংকার তৈরিতে ১ হাজার ৭১ টন সোনা ব্যবহৃত হয়েছিল। তার বিপরীতে বিনিয়োগকারী কেনেন ৭০৯ টন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনেছিল ৫৬৫ টন সোনা।

দেশে কারা কিনছেন সোনা

সরাসরি আমদানি না হওয়া কিংবা কমডিটি এক্সচেঞ্জে বেচাকেনা না হলেও বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়লে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ে। দেশে এখন সোনার ভরি ২ লাখ ১৩ হাজার ৭১৯ টাকা। এই দাম দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

বৈধপথে আমদানি না হওয়ার কারণে ব্যাগজ রুলসে আসা সোনা জোগানের বড় উৎস হয়ে উঠেছে। সে জন্য বিশ্ববাজারের তুলনায় দাম ভরিপ্রতি কয়েক হাজার টাকা বেশি হয়। আবার করোনার পর ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ার কারণেও সোনার দাম তুলনামূলক বেশি হারে বেড়েছে।

একাধিক জুয়েলারি ব্যবসায়ী জানান, সোনার দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন দাম আরও বাড়তে পারে, এমন শঙ্কায় ক্রেতাদের একটা অংশ অলংকার কিনতে জুয়েলারি দোকানে ভিড় করেন। সোনার দাম দুই লাখের কাছাকাছি আসার পরও সেই প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় হালকা ওজনের অলংকারে ঝুঁকছেন ক্রেতারা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) পরিচালক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে সোনার অলংকার। তবে বিয়ে-শাদিতে সোনার অলংকার দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। আগামী দু-তিন বছরে যেসব সামর্থ্যবান পরিবারে বিয়ে-শাদি রয়েছে, তারা অলংকার বানাতে আসছে। এ কারণে বেচাবিক্রি বেড়েছে।