সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে আরজেএসসি, ফটক বন্ধ

আরজেএসসির প্রধান ফটকে এভাবে তালা লাগানো থাকে। আজ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবির ভবনে আরজেএসসির কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

দেশে নিবন্ধিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। স্বাধীনতার আগে দেশি–বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস ও অংশীদারি মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠান ছিল মোট ২০ হাজার ৫টি। স্বাধীনতার পর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিবন্ধিত মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৭৮টিতে।

এ হিসাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সংস্থা যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি)। আরজেএসসির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বেড়েছে ১৩ গুণের বেশি। এর মধ্যে বেশি নিবন্ধন হয়েছে বেসরকারি কোম্পানির।

আরজেএসসির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ছিল এক হাজার ৪৪৫টি, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ছিল ২ হাজার ৩২২টি, বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস ছিল ৩২১টি এবং অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ছিল ১৬ হাজার ৯১৭টি। সব মিলিয়ে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মোট ২০ হাজার ৫টি।

আরও পড়ুন

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির নিবন্ধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৫৫টিতে। আর প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির নিবন্ধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ১১০টিতে। এ ছাড়া বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস বেড়ে ১ হাজার ৬১টি ও অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বেড়ে ৫৫ হাজার ১৪২টি হয়েছে। দেশে এক ব্যক্তির কোম্পানির নিবন্ধন আগে ছিল না। দুই বছর আগে এ সুযোগ দেওয়ার পর থেকে ২২০টি এক ব্যক্তির কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছে।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের বাইরে বাণিজ্য সংগঠন ও সোসাইটি নিবন্ধনও দিয়ে থাকে আরজেএসসি। স্বাধীনতার আগে ৪৭টি বাণিজ্য সংগঠন ও ৫৫৬টি সোসাইটির নিবন্ধন দেওয়া হয়। বর্তমানে নিবন্ধিত বাণিজ্য সংগঠন ১ হাজার ১৬৯টি ও নিবন্ধিত সোসাইটি ১৫ হাজার ৬৭২টি।

আরজেএসসির সাবেক নিবন্ধক আবদুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন পর্যবেক্ষণ করেছেন যে এক-তৃতীয়াংশ কোম্পানি কার্যকর, বাকিগুলো অকার্যকর। কেউ হয়তো ব্যাংকঋণ নেওয়ার জন্য অথবা ভিজিটিং কার্ড ভারী দেখানোর জন্য কোম্পানির নিবন্ধন করেছেন। আবদুল কাইয়ুম বলেন, এখন সময় বদলেছে বলে হুটহাট কোম্পানির নিবন্ধন করা সহজ নয়। কারণ, কোম্পানি থাকার সঙ্গে কর দেওয়ার একটি বিষয় আছে, যা আগে ওইভাবে তদারক করা হতো না।

আরজেএসসির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত বেসরকারি কোম্পানির নিবন্ধন ছিল ৮২ হাজার ৩৪৩টি। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ১১০টি। বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিসও এই ১৪ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ৫৩১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৫১টি।

আরও পড়ুন
আজ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবির ভবনে আরজেএসসির কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রথম আরজেএসসির কার্যালয় স্থাপিত হয়। শুরুর দিকে ভারতের কলকাতা থেকে নিবন্ধিত কোম্পানি, পেশাদার সংগঠন ও অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের কিছু নথিপত্র নিয়ে শুরু হয় সংস্থাটির কার্যক্রম। ১৯৬২ সালে কার্যালয়টি স্থানান্তরিত হয় ঢাকায়।

আরজেএসসিতে কোম্পানি নিবন্ধন করা হয় ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী। আর সোসাইটি নিবন্ধন করা হয় ১৮৬০ সালের সোসাইটি নিবন্ধন আইন অনুযায়ী। এ ছাড়া অংশীদারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয় ১৯৩২ সালের অংশীদারি কারবার আইন অনুযায়ী। এসব প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া আরজেএসসির প্রধান ফটকটি সব সময় বন্ধ থাকছে।

নিবন্ধিত কত প্রতিষ্ঠান কার্যকর আছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরজেএসসি নিবন্ধক শেখ শোয়েবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ হিসাব নেই। তবে অনেকেই নিবন্ধন নেওয়ার পর আর আসেন না। যথাযথ সেবা দিতে আরজেএসসির জনবল আরও বৃদ্ধি করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

আরজেএসসি আরও যেসব সেবা দেয়

নামের ছাড়পত্র
কোনো নতুন কোম্পানি (বিদেশি কোম্পানি ছাড়া), সমিতি অথবা পেশাদার সংগঠনের নিবন্ধনের পূর্বশর্ত হলো নামের ছাড়পত্র নেওয়া। প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি নিবন্ধনের আগে উদ্যোক্তাদের নামের ছাড়পত্র নিতে আরজেএসসি বরাবর আবেদন করতে হয়। নিবন্ধিত, ছাড়পত্রপ্রাপ্ত বা আবেদনকৃত কোনো নামের সঙ্গে মিলে না গেলে বা হুবহু না হলে আরজেএসসি প্রস্তাবিত কয়েকটি নামের মধ্য থেকে যেকোনো একটির বিপরীতে ছাড়পত্র দেয়।

নিবন্ধন

উদ্যোক্তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে আইনের শর্ত পূরণ ও নির্ধারিত মাশুল (ফি) পাওয়ার পর আরজেএসসি নিবন্ধনপত্র দেয়।

রিটার্ন দাখিল

নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ ফরমে ও নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন দাখিল করতে হয় এবং আরজেএসসি সেগুলোর অনুমোদন ও রেকর্ড সংরক্ষণ করে থাকে। দুই ধরনের রিটার্ন আছে—বার্ষিক রিটার্ন ও প্রাতিষ্ঠানিক যেকোনো পরিবর্তনের জন্য রিটার্ন।

প্রত্যয়িত অনুলিপি

কোনো প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডের প্রত্যয়িত অনুলিপির জন্য যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আবেদন করতে পারেন। এমন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত মাশুল পাওয়া সাপেক্ষে আরজেএসসি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অতীত রেকর্ডের প্রত্যয়িত অনুলিপি দিয়ে থাকে। তবে লাভ ও ক্ষতির হিসাব শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুমোদিত ব্যক্তির কাছেই প্রকাশ করা হয়।

নিবন্ধন বাতিল (উইন্ডিং আপ)

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় অথবা আদালতের আদেশে বা প্রতিষ্ঠানের স্মারক অনুসারে নিবন্ধন বাতিল করতে চায় এবং এ–সংক্রান্ত সব নথিপত্রসহ আবেদন করে, তখন আরজেএসসি ওই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়।

বাতিল (স্ট্রাক অফ)

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান আর চলমান না থাকে, তাহলে আরজেএসসি বিধি মোতাবেক সেটির নাম নিবন্ধন বই থেকে কেটে দেয়।

জনবল কি যথেষ্ট

নিবন্ধক হলেন আরজেএসসির প্রধান। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব শেখ শোয়েবুল আলম এ দায়িত্বে আছেন। নিবন্ধকের পর পরই একজন অতিরিক্ত নিবন্ধক এবং ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর ও চট্টগ্রামে একজন করে উপনিবন্ধক রয়েছেন।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তরে দুজন করে এবং চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে একজন করে সহকারী নিবন্ধক রয়েছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর বিভাগীয় কার্যালয়গুলো নিবন্ধকের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। বর্তমান আরজেএসসির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে ৮১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন স্তরে কর্মরত আছেন। আরজেএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, এত প্রতিষ্ঠান বর্তমান জনবল দিয়ে দেখভাল করা সম্ভব নয়।

সদ্য অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া আরজেএসসির উপনিবন্ধক আবু ইশা মোহাম্মদ মোস্তফা ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেবা দেওয়ার চাপ সামাল দিতে মোট জনবল ৩০০ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২৭ জন অনুমোদনও করেছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রথমে করোনা ও পরে বৈশ্বিক মন্দার কথা বলে শেষ পর্যন্ত ২৭ জনও অনুমোদন করেনি।’  

আরজেএসসি থেকে কোম্পানির নামের ছাড়পত্র নিলেও নিবন্ধন পেতে কয়েক দিন ধরে ঘুরতে হচ্ছে বলে জানান সেবাপ্রার্থী নাজমুল হক। গতকাল সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি দপ্তরের ফটক বন্ধ করে রাখা হয়, এমন কাহিনি আরজেএসসি ছাড়া অন্য কোনো দপ্তরে আছে কি না, আমার জানা নেই। এখানে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়েছে, কাউকে না ধরলে কোনো সেবা পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া চতুর্দিকে দালালে ভরা।’

আরও পড়ুন