পাঁচ বছরে সোনার দাম দ্বিগুণ, জুয়েলারি শিল্পের ব্যবসায় মন্দা

দেশের বাজারে ছয় মাস ধরে সোনার ভরি লাখ টাকার ওপরে। যদিও দামি এই ধাতু এখন আর লাখের ঘরে আটকে নেই, সোয়া লাখের দিকে ছুটছে। যেভাবে সোনার দাম বাড়ছে তাতে ক্রেতাদের একটি বড় অংশের কাছে সোনার অলংকার বানানো দুঃস্বপ্নের পর্যায়ে চলে গেছে। আর জুয়েলার্স ব্যবসায়ীদের বড় অংশই ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে আছেন। অবশ্য যাঁদের ঘরে কিংবা লকারে সোনার পুরোনো অলংকার রয়েছে, তাঁরা আছেন সুবিধাজনক অবস্থায়।

দেশে এখন ভালো মান অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের সোনার ভরি ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৮ টাকা। বাংলাদেশ যে বছর স্বাধীন হয়, তার আগের বছর এক ভরি সোনার দাম ছিল ১৫৪ টাকা। অর্থাৎ গত ৫৪ বছরে দাম বেড়েছে ৭৭১ গুণ। এত পেছনে না গিয়ে যদি সাম্প্রতিক সময়ের হিসাব করা হয় তবু দেখা যায়, গত এক দশকে দাম বেড়েছে পৌনে তিন গুণ। আর পাঁচ বছরের ব্যবধানে পৌনে দুই গুণ বেড়েছে।

একাধিক ব্যবসায়ী বলছেন, সোনার দামের উচ্চ মূল্যের কারণে জুয়েলার্সশিল্প আগে থেকেই সংকটে ছিল। গত বছরের শেষের দিকে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়তে শুরু করলে সংকট আরও প্রকট হয়। সোনার অলংকারের বড় ক্রেতাগোষ্ঠী হচ্ছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অথচ তাদের একটা বড় অংশের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে সোনার দাম। এখন উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি সোনার অলংকারের মূল ক্রেতা। তাঁদের কারণে অভিজাত এলাকার জুয়েলার্সগুলো মোটামুটি ব্যবসা করলেও বাকিদের অবস্থা খারাপ। ব্যবসা কমে যাওয়ায় অলংকার তৈরির কারিগরেরাও পেশা বদল করছেন।

বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে সোনার বাজারে সুদিন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তখন এই দাম ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। তার আগে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ সোনার আউন্স ছিল ১ হাজার ৪৭৯ ডলার। গত চার বছরে সোনার দামে উত্থান-পতন থাকলেও দাম করোনার আগের অবস্থায় আর ফেরেনি।

আন্তর্জাতিক গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সোনার বৈশ্বিক জোগান ৩ শতাংশ বাড়লেও চাহিদা ৫ শতাংশের মতো কমেছে। গত বছর খনি ও পুরোনো অলংকার থেকে পাওয়া যায় ৩ হাজার ৬৪৪ টন সোনা। তার বিপরীতে চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৪৪৮ টন। এর মধ্যে ২ হাজার ১৬৮ টন অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশের সোনার বাজার ছোট। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বার্ষিক সোনার চাহিদা ২০-৪০ টন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ পুরোনো অলংকার থেকে পূরণ হয়। বাকিটা ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আসে। অবৈধভাবেও প্রচুর সোনা দেশে আসে। জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফেরাতে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হয়। শুরুতে কিছু আমদানি হলেও নানা জটিলতায় পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।

জানতে চাইলে জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সোনার দাম যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে সৌন্দর্যচর্চার পরিবর্তে সম্পদচর্চায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে উচ্চবিত্তরাই সোনার অলংকারের মূল ক্রেতা। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে দাম। সে কারণে বিক্রিবাট্টাও অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে।

জুয়েলারি ব্যবসায় মন্দাভাব

সোনার দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় নতুন অলংকার বেচাকেনাও ধারাবাহিকভাবে কমে গেছে। তার প্রভাবে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে স্বর্ণশিল্পীদের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। গত দুই দশকের ব্যবধানে স্বর্ণশিল্পীদের সংখ্যা চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে বলে দাবি করেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, করোনার পর জুয়েলারিশিল্প জোড়া ধাক্কা খেয়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সোনার দাম এক দফা বেড়েছে। তারপর যুদ্ধের কারণে সেটি নাগালের বাইরে চলে গেছে।

অলংকার নিকেতনের স্বত্বাধিকারী এম এ হান্নান আজাদ প্রথম আলোকে বলেন,‘ সোনার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পর বেচাবিক্রি খুবই খারাপ। জুয়েলারি ব্যবসা জীবনে এত খারাপ দেখিনি।’

গত তিন বছরে সোনার অলংকার বিক্রিই ৪০-৪৫ শতাংশ কমেছে বলে জানালেন জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি মাসুদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগেও মানুষ বিয়েশাদি কিংবা জন্মদিনের উপহার হিসেবে সোনার আংটি, কানের দুল কিংবা চেইন দিতেন। এখন সোনার বদলে নগদ অর্থ দেন অনেকে।

এদিকে সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় যাঁদের কাছে পুরোনো অলংকার রয়েছে, তাঁদের সম্পদমূল্য বাড়ছে। বর্তমানে সোনার দর যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে বছর পাঁচেকের পুরোনো অলংকার বিক্রি করলেও ভালো মুনাফা মিলবে।

সাধারণত জুয়েলারি দোকানে পুরোনো অলংকার বিক্রি করতে গেলে তারা ওজন করার পর তা কোন ক্যারেটের সোনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হবে। তারপর অলংকারটির বর্তমান ওজন থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। ধরা যাক, কারও কাছে ২০২০ সালে ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকা ভরিতে কেনা ২২ ক্যারেটের এক ভরির সোনার অলংকার রয়েছে। সেটি বিক্রি করলে বর্তমানে ৯৫ হাজার ৭১০ টাকা পাবেন। তাতে মুনাফা দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা। ২১ ও ১৮ ক্যারেটের অলংকার হলে মুনাফা ভিন্ন হবে।

ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী

গয়না হিসেবে সোনা বেশি ব্যবহৃত হয় ভারত ও চীনে। সোনার দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও চীনের তরুণদের মধ্যে সোনার তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। চীনের অনেক তরুণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা মাথায় রেখে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণ দানা (গোল্ড বিনস) কিনে রাখছেন। মুখে খাওয়া বড়ির মতো স্বর্ণের এসব দানার ওজন এক গ্রাম করে। এগুলোর দাম স্থানীয় মুদ্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ ইউয়ান।

চীনের এই উদাহরণের দিকে ইঙ্গিত করে জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, বিশ্বজুড়ে সোনা নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। স্বল্প সময়ে ভালো মুনাফার জন্য অনেকেই সোনায় বিনিয়োগে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশেও অনেকে সোনায় বিনিয়োগ করছেন। সেটি আরও সহজ করতে শিগগিরই কমোডিটি এক্সচেঞ্জে সোনার লেনদেন চালু হবে। দেশে অলংকারের পাশাপাশি বিনিয়োগের মাধ্যমে হিসেবে সোনাকে জনপ্রিয় করা গেলেই জুয়েলার্সশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে।