সংকটের মুখে দেশের পোলট্রিশিল্প

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের পোলট্রি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান। তাঁর ছোট চার শেডের খামারে প্রতি চালানে এক হাজারের মতো ব্রয়লার মুরগি ওঠাতেন। মাসখানেক আগে সর্বশেষ চালানের মুরগি বিক্রির পরে তিনি এখন আর নতুন বাচ্চা ওঠানোর সাহস পাচ্ছেন না। ক্রমাগত মুরগির খাবারের মূল্যবৃদ্ধি তাঁকে চিন্তায় ফেলেছে।

মিজানুর রহমানের মতো দেশে অনেক ক্ষুদ্র খামারির অবস্থা একই। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পোলট্রি পণ্যের উৎপাদন খরচ। এতে যথেষ্ট বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির মতো নিত্যপণ্য। বাজারে অন্যান্য মুরগির দামও বাড়তি। এতে ক্রেতারা পোলট্রি পণ্য কিনছেন কম। কাটতি কম হওয়ায় চাষিরা উৎপাদন কমাচ্ছেন। সংকুচিত হচ্ছে পোলট্রিশিল্পের বাজার।

বেড়েছে পোলট্রি পণ্যের উৎপাদন খরচ। এতে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে ডিম ও ব্রয়লার মুরগি। সংকুচিত হচ্ছে পোলট্রিশিল্পের বাজার।

মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়তি ব্যয় হলে সেই অনুপাতে লাভ হবে কি না, সেই চিন্তা তো আছেই। এখন তার ওপরে যোগ হয়েছে সঠিক সময়ে পণ্য বিক্রির অনিশ্চয়তা। এই ব্যবসায় এত ওঠানামা যে প্রতিদিনই অনিশ্চয়তার ভুগতে হয়।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার পরে যখন পোলট্রিশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, ঠিক তখন চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাড়তে থাকে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম, যা বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়ে দেয়। আমদানিনির্ভর হওয়ায় পোলট্রি খাবারের দাম বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে মুরগি ও ডিমের খুচরা বাজারদরে। ঠিক তখন থেকেই ক্রেতারা পোলট্রি পণ্য কেনা কমানো শুরু করেছেন। এ জন্য খামারিরা উৎপাদন করছেন কম।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের মে মাসে দেশে গড়ে সাপ্তাহিক ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা ছিল ১ কোটি ৮৭ লাখ। আগস্ট মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে গড়ে যা কমে দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে ১ কোটি ৩২ লাখে। অর্থাৎ দেশে প্রতি সপ্তাহে এখন ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা কমেছে ৫৫ লাখ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খামারিরা নতুন করে হিসাবের খাতা মিলিয়ে দেখছেন। লাভের অঙ্ক কমে আসা কিংবা ক্ষতির আশঙ্কা দেখে অনেকে খামার গুটিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে উৎপাদন কমাচ্ছেন।

বিএবি সভাপতি ও কাজী ফার্মস গ্রুপের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুরগির বাচ্চার চাহিদা হ্রাসের অর্থ
হলো খামারিরা উৎপাদন করছেন কম। এতে এই শিল্প যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।’

এই মাসের শুরুতেও যখন মাসিক বাজার করি, তখন ব্রয়লার মুরগি কিনেছি ১৫০ টাকায়, আজ কিনলাম ২০০ টাকায়। ডিমের দাম আজকে একটু কমলেও আগের চেয়ে বেশ বাড়তি। তাই খাওয়া কমিয়েছি।
আকলিমা খাতুন, গৃহিণী

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য বলছে, পোলট্রিজাত পণ্য, মাছ ও গবাদিপশু উৎপাদনে ব্যবহৃত ১৬ ধরনের কাঁচামালের দাম ২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত গড়ে ৬৩ শতাংশের মতো বেড়েছে। এর মধ্যে দুই ধরনের কাঁচামালে ১০০ শতাংশের ওপরে দাম বেড়েছে। আট ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি হারে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম ও দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের প্রভাবে বিকল্প ব্যবস্থায় পোলট্রি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে খামারিদের আরও বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় আরেক দফা বেড়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে চাপে পড়েছে পোলট্রিশিল্পে।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শামসুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই শিল্প সংকুচিত হওয়া মানে এর সঙ্গে জড়িত সব ধরনের ব্যবসা সংকটের মধ্যে পড়া। ইতিমধ্যে মুরগির খাবারের বিক্রি কমে এসেছে।’

বিপিআইসিসি বলছে, দেশে এখন ৮০ থেকে ৯০ হাজার ছোট-বড় মুরগির খামার আছে। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের মতো। এখন আবার কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন করে খামারিরা যে চাপে পড়লেন, তাতে খামারের সংখ্যা আরও কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সে ক্ষেত্রে এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা ৫০ লক্ষাধিক মানুষের যে কর্মসংস্থান হয়েছে, তা কমে আসবে। ছোট হবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পোলট্রিশিল্পের বাজার।

পোলট্রিশিল্প ঝুঁকির মধ্যে আছে উল্লেখ করে বিপিআইসিসির সভাপতি মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সয়াবিন ও ভুট্টা দিয়ে মুরগির খাবারের ৭০-৭৫ শতাংশ উপাদান তৈরি হয়। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। এতে মুরগির দাম বাড়তি, মানুষ কম খাচ্ছে। বেচাকেনা কমে এসেছে। এখনই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে খামারিদের সুরক্ষা দিতে হবে। অন্যথায় সামগ্রিকভাবে পোলট্রিশিল্প বড় সংকটে পড়বে।’

এদিকে সম্প্রতি ব্রয়লার মুরগির এক কেজি মাংসের দাম এক লাফে অর্ধশত টাকা বেড়ে ২০০ হয়েছে। প্রতি হালি ডিমের দাম ওঠে ৫৫ টাকার ওপরে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ক্রেতাদের হালিপ্রতি ন্যূনতম ১৫ টাকা বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত এই দাম বাড়ার পেছনে এ খাতের ব্যবসায়ীরা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের হাত আছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন। তবে হুট করে মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে গ্রাম থেকে শহরে মুরগি-ডিম সরবরাহের বিলম্বকে দায়ী করেছেন অনেক ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশ এগ প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েক মাস ধরে ডিমের দাম কিছুটা বাড়তি। তবে সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির পেছনে জ্বালানির দাম বাড়ানো ও সরবরাহব্যবস্থায় সমস্যাই দায়ী।

দেশে প্রতিদিন ৪ কোটির বেশি ডিম উৎপাদিত হয়। দৈনিক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মুরগির মাংস উৎপাদিত হয় ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এসব মাংস ও ডিমের বড় অংশ আসে গ্রামের খামার থেকে। এসব খামারির বড় অংশ এখন উৎপাদনে থাকবেন কি থাকবেন না, তা নিয়ে দোটানায় আছেন। এই অনিশ্চয়তা যেমন আছে, তেমনি ক্রেতারাও সামগ্রিক চাপে মুরগির মাংস ও ডিমের মতো নিত্যপণ্যের কেনাকাটায় লাগাম টানছেন।

বৃহস্পতিবার মালিবাগ বাজার থেকে ২০০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনেছেন গৃহিণী আকলিমা খাতুন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই মাসের শুরুতেও যখন মাসিক বাজার করি, তখন ব্রয়লার মুরগি কিনেছি ১৫০ টাকায়, আজ কিনলাম ২০০ টাকায়। ডিমের দাম আজকে একটু কমলেও আগের চেয়ে বেশ বাড়তি। তাই খাওয়া কমিয়েছি। দুই সপ্তাহ পর আজ মুরগি কিনলাম, তা–ও আগের চেয়ে ছোট আকৃতির।’

এদিকে বাজারে ডিমের দাম না কমলে সরকার বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতি দিতে পারে—এমন ঘোষণার পরে বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম ১০ টাকার মতো কমে এসেছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিম আমদানি করলেও খরচ বেশিই পড়বে। কারণ, পরিবহন ব্যয় এবং ডিমের সংরক্ষণ পদ্ধতি ব্যয়বহুল। এতে দেশীয় খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। এর চেয়ে বরং কীভাবে খামারিদের সুরক্ষা দিয়ে শিল্পের সংকট কাটানো যায়, সে লক্ষ্যে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।