এফবিসিসিআই, আপনার আসল কাজ কোনটি?

গণমাধ্যমে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। বিষয় হচ্ছে বিজয়ের ৫০ বছর উদ্‌যাপনে পয়লা ডিসেম্বর থেকে ১৬ দিনব্যাপী লাল-সবুজের মহোৎসব করবে এফবিসিসিআই।

এরপর তারা লিখেছে, ‘অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিংবা সামাজিক সূচকের শক্তিশালী অবস্থান, দুর্বল এক শিশুরাষ্ট্র থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল অর্থনৈতিক শক্তি, পরনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে আত্মনির্ভরতায় বলীয়ান হয়ে ওঠা—বাংলাদেশের ৫০ বছরের গল্প সফলতার, অর্জনের।’

এটুকু পড়ে আশান্বিত হয়েছিলাম। মনে হলো, আসলেই ৫০ বছরের অর্জন তো বিশাল, বিশেষ করে অর্থনীতিতে। আর এ অর্জনের কৃতিত্ব তো দেশের উদ্যোক্তাদেরই। অবশ্যই সরকারের নীতিনির্ধারণী ভূমিকা আছে, তবে উদ্যোক্তাদের কৃতিত্বই বেশি। সুতরাং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে এফবিসিসিআইয়েরই বিশাল উৎসব করা মানায়।

উৎসব নিয়ে সংগঠনটি এরপর লিখেছে, ‘যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয় এসেছে, যে মহান নেতার নেতৃত্বে মিলেছে বাঙালির নিজস্ব মানচিত্র, যাঁর সুদক্ষ শাসনে দেশ উঠে এসেছে উন্নয়নের মহাসড়কে, তাঁদের সবার প্রতি বিনম্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজন করেছে ১৬ দিনব্যাপী লাল–সবুজের মহোৎসব।’

এতটুক পড়ে উৎসবের বিষয়বস্তু নিয়ে একটু খটকা লাগলেও আশা-আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিতে মন চাইল না। মনে হলো, ১৬ দিনের উৎসব যেহেতু, সেহেতু ৫০ বছরের অর্থনীতির অর্জন নিয়ে বিশেষ কিছু ঠিকই মিলবে, যা আগামীর যাত্রার প্রতি একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। এতে অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।

আরও পড়ুন

এই ফাঁকে একটু ঘুরে এলাম পাশের দেশ ভারতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা ফিকির ওয়েবসাইটে। ভারতও স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করতে যাচ্ছে। এ জন্য ফিকির একটা প্রতিবেদন পাওয়া গেল সেখানে। প্রতিবেদনের মূল বিষয় ‘ইন্ডিয়া বিয়োন্ড ৭৫’। এবারের রিপোর্টের প্রতিপাদ্য কৃষি খাত। তাদের মূল আলোচনা হচ্ছে ৭৫ বছর তো হয়ে গেল, এখন ভারত ভবিষ্যতে কোথায় যেতে চায়, এর জন্য কী করতে হবে। এ নিয়ে তারা আরও গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করবে।

আর এফবিসিসিআইয়ের ওয়েবসাইটে কী আছে? কেবল নেতাদের ছবি। কোথায় কার সঙ্গে কে দেখা করেছে, সেসব ছবিই বড় বড় করে দেওয়া। এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলে সভাপতির টক শোও স্থান পেয়েছে সেখানে। গবেষণা বলতে আছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব। আর আছে প্রণোদনা তহবিল নিয়ে সরকারের নানা প্রজ্ঞাপন। ব্যস, এটুকুই।

গবেষণা বলতে আসলে কোনো কিছুই নেই এফবিসিসিআইয়ের। তবে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, তা নয়। সুযোগ এসেছে। বিশেষ করে ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করার এই তো সুযোগ।

বাংলাদেশ ছিল সাহায্যনির্ভর দেশ। এখন নিজেদের আমরা বাণিজ্যনির্ভর দেশ বলি। এ জন্য কৃতিত্ব পোশাক খাতের, জনশক্তি রপ্তানি খাতের। কৃষি কেবল এখন জমির মালিক ও কৃষকদের বিষয় নয়, বেসরকারি উদ্যোগ এখানেও আছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যের আছে বিশাল সম্ভাবনা। পোশাক খাতের নির্ভরতা বাড়াতে হবে অন্য খাতেও। সেটা হতে পারে ইলেকট্রনিকস, জাহাজ নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়াজাত পণ্যসহ আরও বেশ কিছু খাত। ব্যাংক খাত ও ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ নিয়েও আছে নানা সমালোচনা। ৫০ বছরের পূর্তিতে এসব নিয়ে আলোচনা করা হবে বলেই ধারণা ছিল। এমনকি আলোচনার বাইরে ৫০ বছরে যাঁরা বাংলাদেশকে অর্থনীতিতে আত্মনির্ভরশীল করতে সহায়তা করেছেন, সেই উদ্যোক্তাদের সম্মাননা জানানোরও একটা সুযোগ ছিল। অন্তত কিছু উদ্যোক্তার নামও নেওয়া যেত।

অথচ এফবিসিসিআই কী করছে? পয়লা ডিসেম্বর থেকে হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে শুরু হয়ে গেছে এফবিসিসিআই আয়োজিত এ মহোৎসব। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১৬ দিনের মহোৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ প্রতিদিনের আয়োজনে বিশেষ অতিথি হিসেবে সশরীর উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং প্রতিদিনের অনুষ্ঠানের শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

অবশ্যই আমরা ৫০ বছরের উৎসব করব, করছিও। কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের কাজ কি কেবলই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা? অর্থনীতি নিয়ে কিছুই কি করার ছিল না? এমনিতেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি এখন সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখায় পরিণত হয়ে গেছে।

১৬ দিনের উৎসবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এ রকম: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আতশবাজি; শিশু–কিশোর ও বিশেষ শিশুদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; নারীদের অংশগ্রহণে বিশেষ অনুষ্ঠান; নজরুল উৎসব; রবীন্দ্র উৎসব; নৃত্য উৎসব; অঞ্চলভিত্তিক অনুষ্ঠান; সশস্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান; লোকসংগীত; চলচ্চিত্র তারকাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান; মঞ্চনাটক ও কনসার্ট।

খুবই ভালো কর্মসূচি সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে অর্থনীতি কই? অবশ্যই আমরা ৫০ বছরের উৎসব করব, করছিও। কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের কাজ কি কেবলই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা? অর্থনীতি নিয়ে কিছুই কি করার ছিল না? এমনিতেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি এখন সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখায় পরিণত হয়ে গেছে। নীতিনির্ধারণ বিষয়ে তাদের নিজেদের কোনো মূল্যায়ন নেই, নিজেদের কোনো অবস্থান নেই, এমনকি ভবিষ্যৎ নিয়েও তাদের কোনো আলোচনা নেই। ব্যবসায়ী সমাজে আসলে এফবিসিসিআইয়ের গুরুত্ব বা ভূমিকা আসলে কি, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। আসলে এফবিসিসিআই ৫০ বছর নিয়ে অর্থনীতি বিষয়ে আলোচনা করবে, এটা আশা করাই ভুল ছিল।