এফবিসিসিআইয়ের কাজটা কী

এফবিসিসিআই

এর আগে মনে হয়েছিল, প্রথা ভাঙার জন্য পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। দেশের সব জায়গায় যেখানে নির্বাচন বিষয়টা উঠেই গেছে, যতটুকু টিকে আছে, তাকে প্রহসনের নির্বাচন বলা যায়, সেখানে সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা অবশ্যই প্রথা ভাঙা। তবে এখন মনে হচ্ছে, আসল ধন্যবাদটা দেওয়া দরকার দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে, আবার প্রথার মধ্যে দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কেননা, এফবিসিসিআই আবারও সদস্যদের ভোট ছাড়াই নেতা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ভোটারদের কষ্ট না দেওয়ার জন্যও এফবিসিসিআইকে একটি বাড়তি ধন্যবাদ।

ভোট ছাড়া নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে এফবিসিসিআইকে অবশ্য সামান্য কষ্ট করতে হয়েছে। পদের সংখ্যা ৩২, কিন্তু মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন ৩৬ জন। অতিরিক্ত চারজন ব্যবসায়ী মনোনয়ন দাখিল করায় তাঁদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ জন্য বিশেষ কোনো স্থান থেকে ধমক দিতে হয়েছে, না বাড়তি কিছু খরচ হয়েছে, তা অবশ্য জানা যায়নি। এ চারজনকেও ধন্যবাদ। মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন বলেই তো নির্বাচন ছাড়াই নেতা বাছাই সম্ভব হয়েছে।

নির্বাচন যেভাবে হয়

একসময় কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনের জৌলুশ ছিল, রীতিমতো উৎসব হতো মতিঝিল এলাকায়। সব পদে সরাসরি নির্বাচন হতো। এমনকি কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট কেনাবেচারও অভিযোগ ছিল। পরে গুরুত্বপূর্ণ চেম্বার ও সমিতির প্রতিনিধিরা যাতে এফবিসিসিআইয়ে আসতে পারেন, সে জন্য ১৮ জন মনোনীত পরিচালকের বিধান রাখা হয়। আর এখন তো পুরো এফবিসিসিআইই মনোনীত।

সংগঠনটির নির্বাচন যেমন গুরুত্ব হারিয়েছে, তেমনি এফবিসিসিআই নিজেও গুরুত্ব ও মর্যাদা হারিয়েছে। এফবিসিসিআই এখন সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখায় পরিণত হয়েছে। সরকারপন্থী ছাড়া এই সংগঠনের পরিচালক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বিদায়ী সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম আওয়ামী লীগেরই শীর্ষস্থানীয় নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের পুত্র। এর আগের সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) এখন সরকারি দলের সাংসদ। আরেক সাবেক সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। আবার আরেক সাবেক সভাপতি প্রয়াত আনিসুল হক আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচিত মেয়র হয়েছিলেন।

আগে থেকেই ঠিক করা হয়, কে সভাপতি হবেন আর কারা পরিচালক হবেন। অবশ্যই সরকারের আস্থাভাজন না হলে মনোনীত হওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। ফলে নির্বাচিত এফবিসিসিআইয়ের কাজ হয় কেবল সরকারকে সমর্থন দেওয়া। সরকারের কোনো অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানেও যেতে পারে না তারা। থাকতে হয় একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত। এমনকি এফবিসিসিআইয়ের সদস্য সারা দেশের চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের নেতা যাঁরা হন, তাঁদেরও হতে হয় সরকারি দলের নেতা, সমর্থক ও অনুগত।

কারা নির্বাচিত হন

এফবিসিসিআইয়ের নতুন সভাপতি হতে যাচ্ছেন বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো . জসিম উদ্দিন। বলা হচ্ছে, তিনি সরকারের সবুজ সংকেত পেয়েছেন। তিনি কদিন আগে নতুন ব্যাংকের অনুমোদনও পেয়েছেন। এবার পেলেন সভাপতির পদ। সুতরাং সরকারের কাছে তাঁর ঋণ কিন্তু মোটেই কম নয়।

বিদায়ী সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম আওয়ামী লীগেরই শীর্ষস্থানীয় নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের পুত্র। এর আগের সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) এখন সরকারি দলের সাংসদ। আরেক সাবেক সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। আবার আরেক সাবেক সভাপতি প্রয়াত আনিসুল হক আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচিত মেয়র হয়েছিলেন। এরও আগে এফবিসিসিআইয়ের দুবারের নির্বাচিত সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন একাধিকবার আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়েছেন এবং সাংসদ সালমান এফ রহমান এখন সরকারের একজন উপদেষ্টা।

এফবিসিসিআইয়ের কাজ কী

এফবিসিসিআই বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন। যেমন ভারতের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা এফআইসিসিআই, যাকে সংক্ষেপে ফিকি বলা হয়।

আরও পড়ুন

এফবিসিসিআইয়ের কাজ কী, এ নিয়ে আলোচনার আগে ফিকির ওয়েবসাইট একটু ঘুরে আসা যাক। শুরুতেই লেখা আছে, ‘এফসিসিসিআই: ইন্ডাস্ট্রিজ ভয়েস ফর পলিসি চেঞ্জ’। অর্থাৎ নীতি পরিবর্তনে শিল্প খাতের কণ্ঠস্বর। আর বাংলাদেশে? এখানে তো এফবিসিসিআইয়ের কণ্ঠস্বর ধ্বংস হয়ে যায় নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সময়েই।

ওয়েবসাইটে এফবিসিসিআই অবশ্য এ রকম কিছু লিখে রাখেনি। কারণ, তারা তো আসলে কোনো ধরনেরই কণ্ঠস্বর নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করছে ঠিকই, কিন্তু এখনো বড় সমস্যা বিনিয়োগ পরিবেশের। একটি সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশের অভাবে বিনিয়োগ তেমন বাড়ছে না, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতির। বিশ্বব্যাংকের করা সহজে ব্যবসা পরিচালনা করার সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে কেবল আফগানিস্তান। কদিন আগেও মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এবং বর্তমান সভাপতি নিহাদ কবির দেশের কর-ব্যবস্থাকে ব্যবসা বৈরী বলে তীব্র সমালোচনা করলেন। অথচ এসব বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের কোনো বক্তব্য নেই, কোনো ভূমিকা নেই।

প্রথা মেনে অর্থনীতি বিষয়ে সরকারের করা বিভিন্ন নীতি বৈঠক বা কমিটিতে এফবিসিসিআইকে সদস্য হিসেবে থাকতে হয়। আর বাজেটের আগে একটা পরামর্শক বৈঠকে সহ-আয়োজক হয় এফবিসিসিআই। তবে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাব বা পরামর্শ কতটা মানা হয়, সেই মূল্যায়ন এফবিসিসিআই করে দেখতে পারে।

করোনার সময়ে সারা বিশ্বের অর্থনীতিই চরম সংকটে। উৎপাদন কমেছে, চাহিদা কমছে আরও বেশি। এ রকম এক সময়ে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতি নিয়ে একের পর এক মূল্যায়ন ও সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেই যাচ্ছে ভারতীয় ফিকি। আর বাংলাদেশের এফবিসিসিআইয়ের ওয়েবসাইটে অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে একটি অক্ষরও খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যাংকগুলো প্রণোদনার ঋণ ঠিকমতো দিচ্ছে না বলে শেখ ফজলে ফাহিম গত বছর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। আর মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) একবার ব্যাংকের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তি চেয়েছিলেন। এ ছাড়া অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের বক্তব্য বা ভূমিকা খুঁজতে গবেষক দল নিয়োগ দিতে হবে।

প্রথা মেনে অর্থনীতি বিষয়ে সরকারের করা বিভিন্ন নীতি বৈঠক বা কমিটিতে এফবিসিসিআইকে সদস্য হিসেবে থাকতে হয়। আর বাজেটের আগে একটা পরামর্শক বৈঠকে সহ-আয়োজক হয় এফবিসিসিআই। তবে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাব বা পরামর্শ কতটা মানা হয়, সেই মূল্যায়ন এফবিসিসিআই করে দেখতে পারে। তাহলে কিছু একটা করছে তারা-এই সান্ত্বনাটুকু অন্তত পাওয়া যাবে।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই হয়ে যাক তাহলে

এর মধ্যেই আবার এফবিসিসিআই ব্যাংক, বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করার কথা জানিয়েছে। গত রোববার অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় এসব বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্তও হয়েছে। করোনা সংকটে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আসল চেহারা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। অর্থ থাকলেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে একটা সময় পর্যন্ত বিদেশে চিকিৎসা নিতে যেতে পারেননি অনেক ব্যবসায়ী। এই অভিজ্ঞতা থেকে যদি বড় ব্যবসায়ীরা উন্নত মানের চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হাসপাতাল করেন, সেটা ভালো সংবাদ।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁদের আসল উদ্দেশ্য ব্যবসা করা। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে চাইবেন, তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ব্যবসায়ী সংগঠন নিজেই ব্যবসা করতে চাওয়া একটি নতুন ও বিস্ময়কর দিক। এমনিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংক, বিমা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কমতি নেই; বরং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার একের পর ব্যাংক, বিমা বা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই ঠিকমতো চলছে না। এখন আবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের কেন ব্যাংক, বিমা বা বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে, তা পরিষ্কার নয়। নাকি বছরের পর বছর ধরে সরকারের অনুগত থাকার পুরস্কার চাচ্ছে এখন এফবিসিসিআই।

ব্যাংক-বিমার পরিবর্তে ভালো একটা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে এফবিসিসিআই, সরকারের প্রণোদনা নীতিকে আরও বাস্তবসম্মত ও কার্যকর করতে একটি সমীক্ষা করতে পারে তারা, অর্থনীতির উত্তরণে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে সরকারকে বিস্তারিত প্রস্তাবও দিতে পারে।

তাহলে বরং একটা কাজ করতে পারে এফবিসিসিআই। বাণিজ্য সংগঠনের নিবন্ধন বাদ দিয়ে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারে। আর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন না বলে অনুগত ব্যবসায়ীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেও নিজেদের ঘোষণা দিতে পারে। সুতরাং এই অবস্থায় তাদের এখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হয়ে যাওয়াটাই ভালো। তারপর ব্যাংক করুক, বিমা প্রতিষ্ঠা করুক-কোনো সমস্যা নেই।

সামনে আরও কঠিন সময় আসছে। অর্থনীতির উত্তরণ নির্ভর করছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ ও সরকারের সহায়ক নীতির ওপর। মহামারির সময়ে সবচেয়ে বিপদে থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বড় অংশই ব্যাংকের বাইরে। তাদের প্রয়োজন আর্থিক সহায়তার। সমস্যা বড়দেরও আছে। অর্থনীতির উত্তরণে সরকারকে এখন যেতে হবে গতানুগতিক নীতির বাইরে। নতুন বাজেট আসছে। সেখানে থাকতে হবে উঠে দাঁড়াবার নীতি ও বরাদ্দ। কিন্তু এসব কিছুই না, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের সব চিন্তাভাবনা এখন ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠার।

আরও পড়ুন

অথচ ব্যাংক-বিমার পরিবর্তে ভালো একটা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে এফবিসিসিআই, সরকারের প্রণোদনা নীতিকে আরও বাস্তবসম্মত ও কার্যকর করতে একটি সমীক্ষা করতে পারে তারা, অর্থনীতির উত্তরণে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে সরকারকে বিস্তারিত প্রস্তাবও দিতে পারে।

অবশ্য এসব প্রত্যাশা পূরণের সক্ষমতা যে এফবিসিসিআইয়ের নেই, তা পরিষ্কার। কেননা, সুবিধা পাওয়ার আশায় একদল অনুগত ব্যবসায়ীর এই সংগঠন সক্ষমতা, গুরুত্ব ও মর্যাদা হারিয়েছে অনেক আগেই। সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছে যেমন এই সংগঠনের গুরুত্ব নেই, সরকারও আমলে নেয় না তাদের মতামত। ফলে দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারণে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না তারা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন কেবল তারা নামেই, কাগজে আর কলমে, আর কোথাও না।