অস্থির ডলার কবে হবে সুস্থির

বিশ্বমন্দার আশঙ্কায় জ্বালানি তেলসহ নানা ধরনের পণ্যমূল্য কমেছে। তারপরও বিশ্ববাজারে ডলার প্রায় আগের মতোই তেজি।

চলতি আগস্ট মাসে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা কমেছে, বেড়েছে রপ্তানি, প্রবাসী আয় আসাও বেড়েছে। এতে দেশের বাজারে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমেছে। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করা ৯৫ টাকায় কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। চাহিদা ও জোগানে এখনো বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো টাকার মান ধরে রাখায় ডলারের আন্তব্যাংক লেনদেন পুরোপুরি বন্ধ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে যে ডলার বিক্রি করছে, তার ৯৫ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে সরকারি কেনাকাটায়। ফলে বেসরকারি খাতের আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে ডলার কিনেই পরিশোধ করতে হচ্ছে।

বিশ্বমন্দার আশঙ্কায় কিছুটা কমেছে জ্বালানি তেলসহ নানা ধরনের পণ্যমূল্য। তারপরও বিশ্ববাজারে ডলার প্রায় আগের মতোই তেজি। ডলার হচ্ছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে আস্থাশীল মুদ্রা। এর বিপরীতে মূল্যমান হারাচ্ছে বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা। রাশিয়ার রুবল, ব্রাজিলের রিয়েল এবং সৌদি রিয়াল ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব মুদ্রাই ডলারের বিপরীতে গড়ে মান হারিয়েছে ১০ শতাংশ হারে। এ অবস্থায় দেশের মধ্যেই মার্কিন ডলারের দাম যেভাবে বেড়েছে, তা কোথায় গিয়ে থামবে, এটাই এখন বড় আলোচনার বিষয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক কেন এখনো বাজারের চেয়ে প্রায় ১০ টাকা কম দামে ডলার বিক্রি করছে, তা বুঝতে পারছি না। এই দামে আর কেউ ডলার কেনাবেচা করছে না।
জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

ডলারের দর কয়টি

বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই গত তিন মাসে ডলারের দাম বাড়িয়েছে প্রায় ৯ টাকা। আর ব্যাংকগুলোতে এই সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর ৯৫ টাকায় স্থির রাখায় দেশে আর্থিক খাতে ডলারের পাঁচটি দর তৈরি হয়েছে। যেমন ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী আয় আনতে প্রতি ডলারে জন্য ১০৫-১০৬ টাকা পর্যন্ত দিচ্ছে। রপ্তানি বিল নগদায়নের ক্ষেত্রে ডলারের দর দাঁড়িয়েছে ১০১ থেকে ১০২ টাকা পর্যন্ত এবং আমদানিকারককে কিনতে হচ্ছে ১০৪ থেকে ১০৫ টাকায়। আর খোলাবাজারে দরের কোনো স্থিরতা নেই, ডলারের দর ১১৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।

আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের দাম কোথায় পৌঁছাবে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো গবেষণা নেই। এর ফলে সময়োপযোগী নীতিকৌশলও নিতে পারেনি। এখনো সনাতন পদ্ধতিতে ডলারের বাজার তদারকি ও দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে হঠাৎ করে যে আমদানিতে খরচ বেড়ে যাবে, তারও কোনো পূর্বাভাস দিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে প্রশ্ন উঠেছে মুদ্রার মান নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি, কৌশল ও সিদ্ধান্ত নিয়ে। কেননা, ডলারের বাড়তি দর মূল্যস্ফীতির চাপকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারের বাজারের অবস্থা থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান পরিষ্কার হওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বাজার নিয়ে কোনো সঠিক নীতি নিতে পারছে না, যা নিচ্ছে তা–ও ধরে রাখতে পারছে না। ফলে চাহিদা-জোগানোর পাশাপাশি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকার ওপরও নির্ভর করছে, ডলারের দাম কোথায় পৌঁছাবে।’

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কেন এখনো বাজারের চেয়ে প্রায় ১০ টাকা কম দামে ডলার বিক্রি করছে, তা বুঝতে পারছি না। এই দামে আর কেউ ডলার কেনাবেচা করছে না। ভয় দেখিয়ে, চাপ দিয়ে এই বাজার ঠিক রাখা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী নীতি না নিলে বাজার শিগগিরই স্থিতিশীল হবে না।’

ডলারের সংকট কেন

এবার ডলারের সংকট বিশ্বব্যাপীই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট পুরোপুরি এড়ানো যেত না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো পদক্ষেপ নিলে সংকটের তীব্রতা কমানো যেত। মূলত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, মূলধনি যন্ত্র, কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়া। এতে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। আর একই সময়ে রপ্তানি আয় ৩৪ শতাংশ বাড়লেও প্রবাসী আয় কমে গেছে ১৫ শতাংশ। প্রবাসী আয় বাড়লেই মূলত দেশ সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। কেননা রপ্তানি আয়ের ৭০-৭৫ শতাংশই কাঁচামাল আমদানিতে খরচ হয়ে যায়। ফলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি খরচ মেটানো যায়নি।

কোথায় ভুল

স্বাধীনতার পর থেকে ১২ বছর মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে বাংলাদেশ পাউন্ডকে বেছে নিয়েছিল। ১৯৮৩ সাল থেকে পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বেছে নেওয়া হয়। ২০০৩ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হয়। এ সময় থেকেই চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো ডলার বিক্রি ও তদারকির মাধ্যমে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকার মান কমে যাওয়া মানে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে গেছে—এ রকম একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা থেকেও টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে রপ্তানি খাতে অবস্থান ধরে রাখতে চীন ব্যাপকভাবে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। এতে প্রতিযোগী প্রায় সব দেশই নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু করলে তখন তাকে মুদ্রাযুদ্ধ বলা হয়েছিল। এরপর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশ নিয়মিত ভিত্তিতে ডলারের সঙ্গে তাদের মুদ্রার মান সমন্বয় করেছে। কেবল বাংলাদেশই ছিল ব্যতিক্রম।

কিন্তু সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরেই টাকার মান কমিয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ। আবার ব্যাংকঋণের সুদহার কমিয়ে রাখায় ঋণও যাচ্ছে দেদার। এতে চাহিদাও কমানো যাচ্ছে না। ফলে ডলারের দাম নিয়ে একরকম বেকায়দায় পড়ে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। না পারছে বাজারকে মেনে নিতে, না পারছে ডলারের চাহিদা মেটাতে।

রিজার্ভের ডলার কোথায় যাচ্ছে

দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডলার মজুত আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। সাধারণত ব্যাংকগুলোর কাছে সীমার বেশি ডলার মজুত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা কিনে নেয়। যার মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ে, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে টাকা ছাড়ে। আর সংকট হলে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে, এর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা চলে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। এই ডলার বিক্রির সময় দাম নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা আন্তব্যাংক দাম হিসেবে পরিচিত।

চলতি অর্থবছরের গত ১০ আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ২০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কিছু ডলার বিক্রি করলেও বাজার থেকে নিট ৭৭০ কোটি ডলার কিনে নেয়। করোনার সে সময় আমদানি হ্রাস ও প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি ডলার কিনে নেওয়ায় রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এখন নিয়মিতভাবে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার। রিজার্ভ বেশি কমে যাবে বলে এখন খুব বেশি ডলার বাজারে ছাড়তেও পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কাদের জন্য ডলার ৯৫ টাকা

বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত দর ৯৫ টাকায় যে ডলার বিক্রি করে, তার বড় অংশ যাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দায় শোধে। চলতি অর্থবছরে বিক্রি করা ডলারের ৫৯ শতাংশ গেছে বিপিসির জন্য, ২০ শতাংশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্য, কীটনাশক আমদানির জন্য গেছে ৯ শতাংশ, সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সাড়ে ৩ শতাংশ, বিদ্যুতের জন্য আড়াই শতাংশ এবং স্যাটেলাইটের জন্য ১ শতাংশ।

আবার বিপিসি বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যে আমদানি ব্যয়, তার পুরো ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক দিচ্ছেও না। একটি অংশ কেবল এই ডলার দিয়ে তাদের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করে যাচ্ছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানকেও অন্য ব্যাংক থেকে ১০৫ টাকার দরে ডলার কিনতে হচ্ছে।

বিকল্প কী

ডলার কেনাবেচায় অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে—এ অভিযোগে ছয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ডলার কেনাবেচায় মুনাফা করা যাবে না—এটা কোনো নীতিমালায় নেই। আবার ছয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় সহযোগী বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছেও আস্থার সংকটে পড়ে গেছে।

ছয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর ডলারের কেনাবেচায় এক টাকার বেশি মুনাফা করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি কমাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রবাসী আয়ের দিকেও নজর দিতে হবে। এখনো অবৈধ পথেই বেশি অর্থ পাচ্ছে প্রবাসীদের পরিবার। পাশাপাশি টাকার আরও অবমূল্যায়ন করে ব্যাংকের কাছাকাছি নিতে হবে ডলারে দাম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলোয় যেহেতু এখনো ডলার ১০০ টাকার ওপরে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক দাম আরও কিছুটা বাড়াতে পারে। ডলারের দামের পার্থক্য এত হলে প্রবাসী আয় অবৈধ পথে বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো যেন বুঝেশুনে ঋণপত্র খোলে, এ জন্য নজরদারি বাড়াতে হবে। যথাযথ পণ্য আমদানি হচ্ছে কি না, তাতেও তদারকি বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন