কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপট: কোন চাকরি হারাবে, কোনটি নিরাপদ

এআই সব চাকরি প্রতিস্থাপন করবে না, তবে কর্মক্ষেত্রের শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দেবে।ফাইল ছবি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আর আউটসোর্সিং দ্রুত বদলে দিচ্ছে বিশ্বের কর্মক্ষেত্রের চেহারা। ফলে নিয়োগকর্তা আর কর্মীরা এখন এক বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে—কোন চাকরি টিকে থাকবে, আর কোন চাকরি মেশিনের হাতে হারিয়ে যাবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, সব চাকরির ওপর সমান প্রভাব পড়বে না। কিছু কাজ নিরাপদ থাকবে, কারণ সেখানে মানুষের প্রতি আস্থা, আইনগত বাধ্যবাধকতা বা শারীরিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়, যেখানে এআই এখনো দুর্বল। আবার কিছু চাকরি, বিশেষ করে যেগুলো বারবার একই জ্ঞানভিত্তিক কাজের পুনরাবৃত্তি করে, সেগুলো দ্রুত এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।

আরও পড়ুন

যেসব চাকরি নিরাপদ—

আস্থা, নীতি এবং কায়িক শ্রম

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ল্যাডার্স ইনক–এর প্রতিষ্ঠাতা মার্ক সেনেদেলা বলেন, যেসব কাজ মানুষের ‘বিচারবোধ বা রুচি’ দিয়ে পরিচালিত হয়, সেগুলো এআইয়ের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। এগুলোতে দরকার সহানুভূতি, সূক্ষ্ম সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং শারীরিক দক্ষতা—যেখানে মানুষের বিকল্প নেই।

ফায়ার সার্ভিস বা উদ্ধারকাজের মতো পেশা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। অ্যাসপেন অ্যানালিটিকস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এআইভিত্তিক কর্মসংস্থান বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু গ্যাডোমস্কি বলেন, ‘আমি আমার মেয়েকে সব সময় বলি, তুমি সব সময় কোস্টগার্ড উদ্ধার সাঁতারু হতে পারবে, তুমি সব সময় ফায়ারফাইটার হতে পারবে।’

এই কাজগুলোতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া, শারীরিক শক্তি এবং দক্ষতার প্রয়োজন হয়—যেখানে রোবট এখনো অনেক সীমাবদ্ধ।

সেনেদেলা যোগ করেন, ‘সিঙ্ক মেরামত করা, নিখুঁত অমলেট তৈরি করা কিংবা বাসস্ট্যান্ড তৈরি করার মতো কাজগুলোতে এখনো মানুষের প্রয়োজন।’

আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের চাকরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দখল করে নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ছবি: রয়টার্স

এআই এই কাজগুলোতে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু পুরোপুরি দখল নিতে পারবে না। উদাহরণ হিসেবে গ্যাডোমস্কি বলেন, ভবিষ্যতে ফায়ারফাইটারদের হেলমেটে এআইচালিত সেন্সর থাকতে পারে, যা শরীরের তাপমাত্রা আর আগুনের তাপ আলাদা করতে সাহায্য করবে। তবে সেটি সহায়ক প্রযুক্তি মাত্র, প্রতিস্থাপন নয়। এআই প্রতিস্থাপন করবে না, বরং কাজকে সহজ করবে।

যেসব কাজ বারবার একই ধরনের জ্ঞান ব্যবহার করে করা হয় এবং যেখানে শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন নেই, সেগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

স্বাস্থ্যসেবা ও সমাজসেবা

যেসব কাজ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এবং সহানুভূতির ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোও নিরাপদ। সেনেদেলার ভাষায়, ‘যেসব কাজের মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান বিতরণ, উৎসাহ দেওয়া এবং পরামর্শ দেওয়া—এআই এখনো সেগুলো করতে পারে না।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রশিক্ষক—এদের কাজ এআইয়ের পক্ষে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। শল্যচিকিৎসকের কাজও তুলনামূলক নিরাপদ। কঠোর নিয়মকানুন এবং বিমা সংস্থার নীতিমালা এখানে বড় ভূমিকা রাখে। গ্যাডোমস্কি বলেন, ‘বিমা কোম্পানিগুলো মানুষের হাতে করা অস্ত্রোপচারে অর্থ ব্যয় করতে স্বস্তি বোধ করে, কিন্তু রোবটের হাতে করা অস্ত্রোপচার নিয়ে তারা এতটা স্বস্তি বোধ করে না।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু কাজ নিরাপদ থাকবে, কারণ সেখানে মানুষের প্রতি আস্থা, আইনগত বাধ্যবাধকতা বা শারীরিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়, যেখানে এআই এখনো দুর্বল।
টুইটার প্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন

আইন পেশা

আইনের জগৎও অনেকটা সুরক্ষিত। প্যারালিগাল বা আইন সহকারীদের কিছু কাজ স্বয়ংক্রিয় হয়ে যেতে পারে। তবে আইনজীবীদের কাজ এআইয়ের পক্ষে দখল করা কঠিন। গ্যাডোমস্কি বলেন, ‘আদালতে কোনো অভিযুক্তের পক্ষে দাঁড়াতে হলে আপনাকে আইনজীবী হতে হবে। বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লাইসেন্স নিতে হবে।’ অর্থাৎ আইনগত বাধ্যবাধকতা মানব আইনজীবীদের কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে টিকিয়ে রাখে।

আরও পড়ুন

ঝুঁকিতে আছে পুনরাবৃত্তিমূলক জ্ঞানভিত্তিক কাজ

যেসব কাজ বারবার একই ধরনের জ্ঞান ব্যবহার করে করা হয় এবং যেখানে শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন নেই, সেগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। গ্যাডোমস্কির ভাষায়, ‘যদি কোনো কাজ তাৎক্ষণিকভাবে বা ক্রমাগতভাবে করা সম্ভব হয় এবং শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন না হয়, তাহলে সেই কাজ স্বয়ংক্রিয় হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।’

এর মধ্যে আছে ট্রান্সক্রিপশন, সময়সূচি তৈরি বা অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ। এআই–চালিত ক্যাপশনিং এবং ভার্চ্যুয়াল অ্যাভাটার ইতিমধ্যেই লাইভ নোট-টেকার এবং সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটারের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে।

বদলে গিয়ে টিকে থাকবে যেসব চাকরি

কিছু চাকরি হারাবে না, তবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে ফিরে আসবে। জর্জি এনথোভেন, হার্ভার্ড এমবিএ গ্র্যাজুয়েট এবং Work That's Worth It পডকাস্টের হোস্ট বলেন, ‘যেসব কর্মী নির্দিষ্ট কোনো ফাংশন নয়, বরং বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে কাজ করেন, তারা এআইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়—বরং সঙ্গী।’

উদাহরণ হিসেবে গ্যাডোমস্কি বলেন, রেডিওলজি টেকনিশিয়ানদের কাজ যেমন এমআরআই স্ক্যানের সময় রোগীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য। এটা রোবট কখনোই করতে পারবে না। তবে এআই ডায়াগনস্টিক প্রক্রিয়া সহজ করবে, ফলে একই কাজের জন্য কম টেকনিশিয়ান প্রয়োজন হবে।

আরও পড়ুন

ট্রাকচালক এবং মালবাহী পণ্য হ্যান্ডলারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এখনো নিরাপদ থাকলেও, স্বয়ংক্রিয় যানবাহন যদি মানুষের চেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী প্রমাণিত হয়, তবে এই চাকরিগুলো দ্রুত হারিয়ে যাবে।

ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ

এআই সব চাকরি প্রতিস্থাপন করবে না, তবে কর্মক্ষেত্রের শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দেবে। সব কাজ মানুষের সহানুভূতি, জবাবদিহি এবং শারীরিক উপস্থিতি দাবি করে—যেমন আইন, চিকিৎসা, জরুরি সেবা, দক্ষ পেশা—সেগুলো নিরাপদ। কিন্তু পুনরাবৃত্তিমূলক জ্ঞানভিত্তিক কাজ ইতিমধ্যেই অদৃশ্য হতে শুরু করেছে। তথ্যসূত্র ইউএসএ টুডে