বিসিএস নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারের দায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা

বর্তমানে চাকরিপ্রার্থীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। সিভিল সার্ভিসের সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত—দুই ক্যাটাগরিতে মোট ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। প্রতিটি ক্যাডারের দায়িত্ব ও কাজ, পদায়ন ও প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করা হচ্ছে চাকরি-বাকরি পাতায়। আজ চতুর্থ পর্বে থাকছে বিসিএস নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারের দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা। এ বিষয়ে জানাচ্ছেন ৩৫তম বিসিএসের কর্মকর্তা রবিউল আলম লুইপা

তরুণ–তরুণীদের কাছে স্বপ্নের চাকরি িবসিএস
ছবি: প্রথম আলো

বিসিএস (নিরীক্ষা ও হিসাব) ক্যাডার

সরকারি ব্যয় কার্যক্রম পরিচালনা এবং এর সঙ্গে জড়িত জবাবদিহি নিয়ে অডিট করাই হলো বিসিএস নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডার কর্মকর্তাদের কাজ। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় বিসিএস (নিরীক্ষা ও হিসাব) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিসহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। 

পদায়ন, দায়িত্ব ও কাজ 

হিসাব ও নিরীক্ষা ক্যাডারের দুটি বিভাগ হলো—অডিট অধিদপ্তর ও অ্যাকাউন্টস বিভাগ। অ্যাকাউন্টস বিভাগের তিনটি সার্কেল/উইংস হলো সিভিল, ডিফেন্স এবং রেলওয়ে। এই দপ্তরগুলোয় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়।

দেশের যেখানেই সরকারি টাকার কার্যক্রম, সেখানেই অডিট ক্যাডারের কাজ। এমনকি সরকারি টাকা যদি দেশের বাইরেও যায়, সেখানেও অডিট ক্যাডার কাজ করে। সরকারের বাজেটের টাকা খরচ করা হয় অ্যাকাউন্টস বিভাগের মাধ্যমে, একে প্রি-অডিট বলা হয়। খরচ হওয়ার পর সেটির সত্যতা ও শুদ্ধতা যাচাই করা হয়, একে পোস্ট বা স্ট্যাটাটরি অডিট বলা হয়। পোস্ট-অডিটের যে অংশে সঠিক রুলস ও প্রসিডিউর অনুযায়ী খরচ হয়েছে কি না (অর্থাৎ যেখানে যতটুকু খরচ করা নিয়ম, সেখানে ততটুকু করা হয়েছে নাকি বেশি করা হয়েছে) সেটি দেখা হয়, তাকে কমপ্লায়েন্স অডিট এবং যে অংশে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের (যেমন বন বিভাগ, ওয়াসা ইত্যাদি) কন্ট্রিবিউশন মূল্যায়ন করা হয়, তাকে পারফরম্যান্স অডিট বলা হয়।

আরও পড়ুন

সারা বিশ্বেই সরকারি অডিট প্রতিষ্ঠানকে সুপ্রিম অডিটরি ইনস্টিটিউশন বলা হয় এবং এই প্রতিষ্ঠান যে স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে তাকে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অব সুপ্রিম অডিট ইনস্টিটিউশন (আইএসএআই) বলা হয়। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি)—নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের সাংবিধানিক প্রধান হলেও তিনি মূলত ফর্মস অ্যান্ড ম্যানার দেখে থাকেন। তাঁকে সহায়তা করার জন্য একজন ডেপুটি সিএজি সিনিয়র রয়েছেন। হিসাব (সিভিল, ডিফেন্স ও রেলওয়ে) এবং নিরীক্ষা বিভাগের আলাদা আলাদা প্রধান আছেন, যাঁরা প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন।

অডিট অধিদপ্তর

বর্তমানে দেশে ১৭টি অডিট অধিদপ্তর আছে। একজন মহাপরিচালক প্রতিটি অধিদপ্তরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধীনে পরিচালক, উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালক রয়েছেন। ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে এই অধিদপ্তরগুলোয় অ্যাকাউন্টস অফিসার, সুপারিনটেনডেন্ট, অডিটর এবং জুনিয়র অডিটর রয়েছেন।

আরও পড়ুন

হিসাব (সিভিল)

অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হিসাব (সিভিল) বিভাগে পোস্টিং হলে ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরে পদায়ন হতে পারে। পদায়নের ওপর ভিত্তি করে পদনাম নির্ধারিত হয়। ঢাকার হিসাব ভবন অফিসে কন্ট্রোলার জেনারেল অব অ্যাকাউন্টস (সিজিএ) অফিস প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধীনে অ্যাডিশনাল সিজিএ, ডেপুটি সিজিএ, অ্যাসিস্ট্যান্ট সিজিএ বণ্টন করা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আবার ঢাকায় মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ৫২টি আলাদা চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স (সিএএফও) অফিস আছে, যেখানে সিএএফও অফিস প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর অধীনে ডেপুটি সিএএফও, অ্যাসিস্ট্যান্ট সিএএফও বণ্টন করা দায়িত্ব পালন করেন। বিভাগীয় পর্যায়ে (আট বিভাগে আটজন) ডিভিশনাল কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্টস (ডিসিএ) অফিস প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাঁর অধীনে ডেপুটি ডিসিএ এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিসিএ বণ্টন করা দায়িত্ব পালন করেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অডিট ক্যাডারের পদায়ন দেওয়া হয় না। জেলা ও উপজেলায় জেলা অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার (ডিএএফও), উপজেলা অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার (ইউএএফও), সুপারিনটেনডেন্ট, অডিটর এবং জুনিয়র অডিটর প্রভৃতি পদে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন।

হিসাব (ডিফেন্স)

ঢাকা হেড অফিসে কন্ট্রোলার জেনারেল অব ডিফেন্স ফাইন্যান্স (সিজিডিএফ) এ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধীনে জয়েন্ট সিজিডিএফ, ডেপুটি সিজিডিএফ এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট সিজিডিএফ বণ্টন করা দায়িত্ব পালন করেন। হেড অফিসের অধীনে ঢাকায় আর্মি/নেভি/এয়ারের তিনটি এজেন্সি অফিস আছে, যেখানে সিনিয়র ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার (এসএফসি) অফিসপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসএফসির অধীনে ডেপুটি এসএফসি এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট এসএফসি বণ্টন করা দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার এসএফসি অফিসের অধীনে বিভিন্ন বিভাগে এরিয়া ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার আর্মি/নেভি/এয়ারের আলাদা অফিস রয়েছে।

আরও পড়ুন

হিসাব (রেলওয়ে)

ঢাকা রেলভবনে অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (এডিজি) ফাইন্যান্স এই বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধীনে ডেপুটি ডিরেক্টর (ডিডি) ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর (এডি) বণ্টন করা দায়িত্ব পালন করেন। রেলভবনের অধীনে রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে আলাদা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজার অ্যান্ড চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার (এফএসিএও) অফিস প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অধীনে ডেপুটি ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজার (ডিএফএ) এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজার (এএফএ) কাজ করেন।

প্রশিক্ষণ

যোগদানের পর নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা অন্য ক্যাডারদের সঙ্গে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিপিএটিসি) ছয় মাস মেয়াদি বনিয়াদি প্রশিক্ষণ (ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্স—এফটিসি) সম্পন্ন করেন। এরপর প্রফেশনাল দক্ষতা অর্জনের জন্য ঢাকার মিরপুরে ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট একাডেমিতে (ফিমা) এক বছর মেয়াদি বিভাগীয় প্রশিক্ষণ নিতে হয় তাঁকে। এ ছাড়া দেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। অন্য ক্যাডারের মতো সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিভিন্ন দেশে মাস্টার্স এবং পিএইচডি পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে।

বেতন ও ভাতা

এ ক্যাডারের একটি বিশেষ দিক হলো সব সরকারি কর্মচারী ভোটেড এক্সপেনডিচার (বেতনের জন্য সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়) থেকে বেতন উত্তোলন করলেও আপনার পদায়ন অডিট অধিদপ্তরে হলে আপনি চার্জড এক্সপেনডিচার (সাংবিধানিক সংস্থা) থেকে বেতন পাবেন। সরকারি বেতন স্কেল–২০১৫ অনুসারে সব ক্যাডারের কর্মকর্তা ২২ হাজার টাকা মূল বেতনে চাকরিজীবন শুরু করেন। যোগদানের সময় একটি অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পর মূল বেতন হয় ২৩ হাজার ১০০ টাকা। এ ছাড়া মূল বেতনের নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া (জেলা শহরে ৪০ শতাংশ, অন্যান্য বিভাগে ৪৫ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ৫০ শতাংশ), ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, সন্তানের জন্য শিক্ষাসহায়ক ভাতা, ঈদ বা পূজায় উৎসব ভাতা, বৈশাখে নববর্ষ ভাতা, সরকারি দায়িত্ব ও যাতায়াতের জন্য টিএ/ডিএ ভাতাসহ সরকারি সব আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন

সুযোগ-সুবিধা

এ ক্যাডারে মোটামুটি ভালো ডেপুটেশন–সুবিধা আছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, বিভিন্ন প্রজেক্ট (মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু), সিটি করপোরেশন ইত্যাদিতে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লিয়েন ও ডেপুটেশন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে মিশন অডিটের (৪০ দিন) মাধ্যমে আর্থিকভাবে উপকৃত হওয়ার সুযোগ আছে। মিশন অডিটে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সেবা ও বিদেশ ভ্রমণ হয়, অন্যদিকে আর্থিক সচ্ছলতাও সম্ভব। প্রমোশন-সুবিধা তুলনামূলক ভালো। ৯ম ও ৬ষ্ঠ গ্রেডে কর্মরত থাকলে শেয়ারড ট্রান্সপোর্ট এবং ৫ম গ্রেড থেকে অফিস ট্রান্সপোর্ট-সুবিধা রয়েছে। সাধারণ সরকারি কর্মকর্তাদের মতো কোয়ার্টার সুবিধার পাশাপাশি ডিফেন্স ও রেলওয়েতে কর্মরত থাকাকালে নিজ নিজ কোয়ার্টার ব্যবহারের সুবিধাও রয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই ক্যাডারের পদায়ন নেই। ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগে সিভিল অফিস, ডিফেন্স ও রেলওয়েতে পদায়ন করা হয়। রাষ্ট্রীয় হিসাবের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানের সুযোগ ও ভালো কর্মপরিবেশের জন্য অনেক চাকরিপ্রার্থী এ ক্যাডারকে বিসিএসে পছন্দক্রমের প্রথম দিকে রাখেন।