সরকারি চাকরির নিয়োগে অস্থিরতা: চার মাসে চাকরিপ্রত্যাশীদের যত আন্দোলন
বাংলাদেশে সরকারি চাকরি পাওয়া যেন যুদ্ধজয়ের সমান। আর চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন এখন নিত্যদিনের দৃশ্য। স্মারকলিপি, অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন, অনশন থেকে শুরু করে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ—দাবি আদায়ে কর্মসূচির ধরনও বহুবিধ। চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি চাকরির নিয়োগ নিয়ে নানামুখী আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যে কিছু সমাপ্ত হলেও অনেক আন্দোলন এখনো চলমান বা সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে।
৪৩তম বিসিএস: নন-ক্যাডার প্রার্থীদের অনশন
নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী, ৪৩তম বিসিএসে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের ফল একসঙ্গে প্রকাশ করা হয়। নিয়োগ জটিলতা এবং কমসংখ্যক সুপারিশের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন নন-ক্যাডার প্রার্থীরা। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তাঁরা ‘বিসিএস চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে প্রায় ১০ দিন অনশন চালান। এর আগে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন তারা। দীর্ঘ আন্দোলনেও সমাধান না মেলায়, এখন আদালতের আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রার্থীরা।
৪৪তম বিসিএস: ক্যাডার নিয়োগে বিলম্ব
নিয়োগ বিলম্বের কারণে আন্দোলনের মাঠে আছেন ৪৪তম বিসিএসের ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্তরাও। দুই দফা সংশোধনের পর ১১ নভেম্বর ২য় সম্পূরক ফল প্রকাশ করে পিএসসি। সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীরা জানাচ্ছেন, ৪৪তম বিসিএসে তাদের চূড়ান্ত ফলাফলের ফাইল ৩ বছর ১১ মাস ২৫ দিন পরেও জনপ্রশাসনে পাঠানো হয়নি। দ্রুত নিয়োগের দাবিতে রোববার তারা মানববন্ধন করেছেন। পিএসসি আশ্বস্ত করেছে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ফাইল মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে।
৪৭তম বিসিএস: লিখিত পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে আন্দোলন
৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি-উত্তীর্ণ প্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে স্মারকলিপি, মিছিল, অবরোধ ও অনশনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। নীলক্ষেত ও শাহবাগ মোড় অবরোধের পাশাপাশি রাজশাহী ও ময়মনসিংহে রেলপথও অবরুদ্ধ হয়। তবে পিএসসি জানিয়েছে, পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন হবে না। ঘোষণার পর আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়েছে। লিখিত পরীক্ষা ঘনিয়ে আসায় বেশির ভাগ প্রার্থী এখন প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিচ্ছেন।
প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ: পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান এবং দুই বছর অন্তর বিশেষ নিয়োগের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ। ১৯ অক্টোবর থেকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন তারা। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গেলে ব্যর্থ হন এবং ২৭ অক্টোবর শাহবাগে মিছিলে বহিরাগতদের হামলার শিকার হন। পরে ১২ নভেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামনে অবস্থান নিলে সমাজসেবা উপদেষ্টার আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করা হয়। তবে চলতি মাসে প্রজ্ঞাপন না এলে ডিসেম্বর থেকে পুনরায় আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
পরিসংখ্যান ব্যুরো: প্রকল্পে নিয়োগ থাকলেও কাজ নেই
২০১৬ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘ডেভেলপমেন্ট অব দ্য প্রভার্টি ডেটাবেজ’ প্রকল্পে ৫৪৫ জন অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান। অভিযোগ অনুযায়ী, প্রকল্পকর্মী হয়েও দীর্ঘদিন রাজস্ব শাখায় কাজ করেন এবং ২০২২ সালে প্রকল্পে ফিরে একই বছরের ডিসেম্বরে কার্যক্রম বন্ধ হয়। হাইকোর্টের রায়ে প্রকল্প ২০২৬ পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে বেতন বন্ধ হয়। ২৬১ জন রিট করে বেতন-ভাতা বহাল রাখার দাবি জানান। অক্টোবরের ৫-১৪ তারিখে অবস্থান কর্মসূচি পালন শেষে ব্যুরোর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করা হয়।
এনটিআরসিএ: শিক্ষক নিবন্ধন নিয়ে আন্দোলন
১-১২তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের অনেকের বয়স ৩৫ ছাড়িয়ে গেছে এবং সনদের মেয়াদ শেষ। শূন্য পদে আবেদন করেও সুপারিশ না পাওয়া অভিযোগে তারা আন্দোলন শুরু করেন। এনটিআরসিএ জানিয়েছে, আদালতের রায়ের কারণে বিশেষ নিয়োগের এখতিয়ার নেই; শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। আন্দোলনে বিরতি দিয়ে প্রার্থীরা আবার কর্মসূচি শুরু করেছেন এবং রোববার কার্যালয় অবরোধ করেছেন। ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেও সুপারিশ থেকে বাদ পড়া প্রার্থীরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন। তাদের অভিযোগ, ৬০ হাজারের বেশি শূন্য পদ থাকলেও এনটিআরসিএ তাদের নিয়োগ দেয়নি। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দাবির সময় বেঁধে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
৪৮তম বিসিএস: পদসংখ্যা বৃদ্ধির দাবি
রিপিট ক্যাডার সমস্যা সমাধান এবং ৪৮তম বিশেষ বিসিএসে ৩ হাজার ৫০০-র বেশি চিকিৎসক নিয়োগের দাবিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা আন্দোলনে নামেন। অভিযোগ, ৪৪-৪৭তম বিসিএসের অসম্পূর্ণ নিয়োগের কারণে অপেক্ষমাণ চিকিৎসক আবার সুপারিশ পেয়েছেন, যা প্রায় ১,৫০০ রিপিট প্রার্থী তৈরি করবে। ফলে পদ শূন্য হয়ে চিকিৎসক সংকট বাড়বে। তবে ৩০ অক্টোবর সরকার জানায়, ৪৮তম বিসিএসে পদ বৃদ্ধির সুযোগ নেই। সরকারি ঘোষণার পর আন্দোলন স্তিমিত হয়।
পেট্রোবাংলা: নিয়োগে বিলম্ব
পেট্রোবাংলা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানে সুপারিশপ্রাপ্তদের দ্রুত নিয়োগপত্র প্রদানের দাবিতে আন্দোলন হয়। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের প্রায় ৯ মাস পরও নিয়োগ বিলম্ব হওয়ায় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পেট্রোবাংলার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ধাপে ধাপে নিয়োগপত্র প্রদান শুরু করে।