সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে যা জানা জরুরি
প্রাথমিক শিক্ষা একজন মানুষের শিক্ষা জীবনের প্রথম ধাপ। সেই ধাপকে শক্ত ভিত দিতে কাজ করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাঁদের হাতে গড়ে ওঠে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবারও সৎ, নিষ্ঠাবান, যোগ্য ও উদ্ভাবনীশক্তিসম্পন্ন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। সম্প্রতি দুই ধাপে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১৪ হাজার ৩৮৫ পদে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে রাজস্ব খাতে। বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী (১১,০০০-২৬,৫৯০ টাকা), পদটি ১৩তম গ্রেডে।
যোগ্যতা ও বয়সসীমা—
আবেদনকারীর বয়স হতে হবে ৩০ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ২১ থেকে ৩২ বছর। কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে অন্যূন দ্বিতীয় শ্রেণি বা সমমানের সিজিপিএসহ (৪ স্কেলে ন্যূনতম ২.২৫ ও ৫ স্কেলে ন্যূনতম ২.৮) স্নাতক বা স্নাতক (সম্মান) বা সমমানের ডিগ্রি। শিক্ষাজীবনে কোনো স্তরে তৃতীয় বিভাগ অথবা সমমানের জিপিএ অথবা তৃতীয় শ্রেণি অথবা সমমানের সিজিপিএ গ্রহণযোগ্য হবে না।
অনলাইনে আবেদনের প্রক্রিয়া—
আবেদন করা যাবে ওয়েবসাইটে । প্রথমে আবেদন ফর্ম পূরণ করে Draft Applicant’s Copy প্রিন্ট করে তথ্য যাচাই করতে হবে। সঠিক তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর টেলিটক প্রিপেইড নম্বর থেকে ১১২ টাকা ফি (সার্ভিস চার্জসহ) ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এরপর SMS-এর মাধ্যমে প্রার্থী পাবেন User ID ও Password, যা ব্যবহার করে Final Applicant’s Copy ডাউনলোড করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আবেদন ফি জমা দেওয়ার পরই আবেদন চূড়ান্তভাবে গৃহীত বলে গণ্য হবে। পরবর্তী সময়ে আর কোনো তথ্য সংশোধনের সুযোগ থাকবে না।
প্রবেশপত্র ও যোগাযোগ—
পরীক্ষার সময়সূচি চূড়ান্ত হলে প্রার্থীদের SMS-এর মাধ্যমে জানানো হবে। একই নম্বরে পরীক্ষাসংক্রান্ত সব যোগাযোগ হবে। তাই আবেদনপত্রে দেওয়া মোবাইল নম্বরটি সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হবে।
সতর্কতা ও নির্দেশনা—
ধূমপায়ী বা মাদকাসক্ত প্রার্থীদের আবেদন করা যাবে না।
বিবাহিত নারী প্রার্থীরা স্বামী বা পিতার স্থায়ী ঠিকানার যেকোনো একটি ব্যবহার করতে পারবেন।
আবেদনকারীর প্রার্থিতা কেবল নিজ উপজেলা বা শিক্ষা থানার শূন্য পদে বিবেচিত হবে।
কোনো ভুল তথ্য বা জেলা-উপজেলা ভুল উল্লেখ করলে প্রার্থিতা বাতিল হবে।
প্রয়োজনে ই–মেইল করতে পারেন [email protected] ঠিকানায় অথবা টেলিটকের কাস্টমার কেয়ার নম্বর ১২১-এ যোগাযোগ করা যাবে।
লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা—
লিখিত (MCQ) পরীক্ষা হবে ৯০ নম্বরের, মৌখিক ১০ নম্বরের—মোট ১০০ নম্বর। লিখিত পরীক্ষার সময় ৯০ মিনিট, ভুল উত্তরের জন্য ০.৫ নম্বর কাটা যাবে। লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম ৫০% নম্বর পেতে হবে।
লিখিত পরীক্ষার বিষয় ও নম্বরবণ্টন—
বাংলা: ২৫
ইংরেজি: ২৫
সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক): ২০
গণিত ও দৈনন্দিন বিজ্ঞান: ২০
চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা-২০২৫ এবং ২ নভেম্বর ২০২৫ সালের সংশোধন অনুযায়ী।
পরীক্ষার প্রস্তুতির পরামর্শ—
পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রথমে পরীক্ষার মানবণ্টন সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। বিগত বছরের প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ ২০০৯-২০২৩ পরীক্ষা, প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ, এটিইও, টিইও ও পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে পড়তে হবে। সব চাকরির পরীক্ষায় বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন এসে থাকে তা যথাযথ অনুশীলন করতে হবে।
বাংলা—
কারক, সন্ধি, সমাস, বাগধারা, বিপরীত শব্দ, প্রতিশব্দ, বাক্য সংকোচন ইত্যাদি নিয়মিত চর্চা করুন। সাহিত্য অংশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, সুকুমার রায়, শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, জহির রায়হানসহ গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতা ও রচনাগুলো ভালোভাবে পড়ুন।
সহায়ক বই: ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির এনসিটিবির বাংলা ব্যাকরণ ও সাহিত্য বই।
ইংরেজি—
Grammar অংশে Parts of Speech, Tense, Voice, Narration, Preposition, Correction, Synonym-Antonym, Idioms-Phrase অনুশীলন জরুরি।
সহায়ক বই: NCTB Grammar বই ও নামকরা লেখকদের Grammar Practice Book।
সাধারণ জ্ঞান—
সাধারণ জ্ঞানে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি রয়েছে। বাংলাদেশ বিষয়াবলির জন্য বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন, সীমানা, জনসংখ্যা, উপজাতি, বাংলাদেশের ঐতিহ্য, স্থাপনা, নিদর্শন, প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, সুলতানি শাসন, মুঘল শাসন, ব্রিটিশ শাসন, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই গণ–অভ্যুত্থান, বাংলাদেশের সংবিধান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রশাসনিক কাঠামো, পুরস্কার, খেলাধুলা, বাংলাদেশের জনপদ, নদ-নদী, প্রাকৃতিক সম্পদ, বিখ্যাত স্থান, জাতীয় দিবস, প্রাথমিক শিক্ষা–সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্ন ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক সীমারেখা, প্রণালি, দ্বীপ, সাগর, মহাসাগর, চুক্তি, যুদ্ধ, সম্মেলন, সংগঠন, সংস্থা, দেশ, মুদ্রা, রাজধানী, আন্তর্জাতিক দিবস, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংগঠন, খেলাধুলা, পুরস্কার, আন্তর্জাতিক সভ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ কর্তৃক বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা, ভূগোল, অর্থনীতি পৌরনীতি (৯ম-১০ম শ্রেণি) বইগুলো পড়লে বিষয়বস্তু সমন্ধে ধারণা পাবেন। এ ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে সংবাদ দেখতে হবে এবং পড়তে হবে।
সহায়ক বই: এনসিটিবির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, ভূগোল ও অর্থনীতি বই।
গণিত ও বিজ্ঞান—
গণিত বিষয়ে আতঙ্কিত না হয়ে অধিক অনুশীলনে বেশি নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। গণিত বিষয়টি তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে—ক) পাটিগণিত, খ) বীজগণিত এবং গ) জ্যামিতি।
পাটিগণিতের জন্য মূলদ ও অমূলদ সংখ্যা, মৌলিক সংখ্যা, ভগ্নাংশ, শতকরা, ঐকিক নিয়ম, লাভ-ক্ষতি, সুদ-কষা, গড়, ধারা, লসাগু এবং গসাগু। পাটিগণিত অনুশীলনীর জন্য পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ গণিত বোর্ড বই অনুশীলন অনেক কাজে লাগে।
বীজগণিতের জন্য বীজ গাণিতিক রাশি, মাননির্ণয়, উৎপাদক বিশ্লেষণ, সরল সমীকরণ, সূচক, লগারিদম, সেট, ফাংশন ইত্যাদি অনুশীলনীর জন্য ষষ্ঠ-নবম শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ গণিত বোর্ড বই অনুশীলন করলে ভালো করা যায়।
জ্যামিতিক অংশে রেখা ও কোন, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত এবং ত্রিকোণমিতি ও পরিমিতি পরীক্ষায় আসে, যা অনুশীলনীর জন্য ষষ্ঠ-নবম শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ জ্যামিতিক অংশ বোর্ড বই অনুশীলন করলে ভালো করা যায়।
গণিতের সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রশ্ন আসবে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পদার্থের অবস্থা, এটমের গঠন, মৌলিক কণা,অম্ল, ক্ষারক, লবণ ভৌত রাশি, চৌম্বকত্ব, তড়িৎ চৌম্বক, তরঙ্গ, শব্দ, তাপ, শক্তির উৎস, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস, পারমাণবিক শক্তি, শক্তির রূপান্তর, খনিজ উৎস, তড়িৎ কোষ, এক্সরে, অজৈব যৌগ, জৈব যৌগ, তেজস্ক্রিয়তা, টিস্যু, জেনেটিকস, জীববৈচিত্র্য, প্ল্যান্ট ডাইভারসিটি, অ্যানিম্যাল ডাইভারসিটি, প্রাণিজগৎ, সালোকসংশ্লেষণ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদ, ফুল, ফল, রক্ত সঞ্চালন, রক্তচাপ, হৃদ্রোগ ও স্নায়ুরোগ, খাদ্য ও পুষ্টি, প্ল্যান্ট নিউট্রিশন, ভিটামন পরাগায়ন, বায়ুমণ্ডল, জোয়ার-ভাটা, টেকটোনিক প্লেট, সুনামি, সাইক্লোন, রোগের কারণ ও প্রতিকার, রোগজীবাণু ইত্যাদি পড়তে হবে। এ ছাড়া আইসিটি বিষয়ে মৌলিক ধারণা থাকতে হবে।
সহায়ক বই: ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির এনসিটিবির গণিত ও বিজ্ঞান বই।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের জমা দিতে হবে যেসব কাগজপত্র—
১. অনলাইন আবেদনপত্রের প্রিন্ট কপি ও দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি
২. শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র
৩. নাগরিকত্ব সনদ
৪. জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের কপি
৫. প্রবেশপত্রের সত্যায়িত কপি
৬. কোটাধারীদের প্রযোজ্য সনদপত্র (মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ইত্যাদি)
প্রস্তুতিতে যা মনে রাখবেন—
নিয়মিত অধ্যয়ন করুন। পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ এবং মডেল টেস্ট অনুশীলনই সাফল্যের চাবিকাঠি।
*লেখক: বিশ্বজিৎ সুর সহকারী শিক্ষক, গোয়ালনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোতোয়ালি, ঢাকা।