করোনা রোধে লকডাউনই কি একমাত্র সমাধান

লকডাউনের কারণে ফাঁকা সিডনির অপেরা হাউস।
লকডাউনের কারণে ফাঁকা সিডনির অপেরা হাউস।

বাসা থেকে উত্তরখান মাজার পর্যন্ত হেঁটে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বা রিকশা নিয়ে আজমপুর পর্যন্ত যেতে হয়। তারপর সেখান থেকে বাসে অফিস।

সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছানোর জন্য খুব সকাল সকাল রওনা দিতে হয়। বাসের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় লাইনে দাঁড়িয়ে। আজমপুর ওভারব্রিজের ঠিক পাশেই রাস্তার ওপর ফুটপাতে ততক্ষণে একদল মানুষ দুই সারিতে ভাগ হয়ে বসে যায়। এই মানুষদের মধ্যে ছেলেমেয়ে দুই রকমই আছে। আবার কমবয়সী থেকে শুরু করে প্রৌঢ়বয়সীও আছেন। উনারা সবাই দিনমজুর। উনারা সকালবেলা এসে এখানে লাইন দিয়ে বসেন। এরপর বিভিন্ন ঠিকাদার বা বাড়ির মালিকেরা এসে সেখান থেকে উনাদের বাছাই করে নিয়ে যান। এখানে নারীদের কদর বেশি। কারণ, সবাই জানে নারীরা কাজে কখনোই ফাঁকি দেন না। আবার তাঁদের কম মজুরি দিলেও রা করেন না। তাই দুই ভাবেই লাভবান হওয়া যায়। এই মানুষগুলো দিন আনে দিন খায় অবস্থায় জীবন যাপন করেন। উনাদের কোনো জমানো টাকা নেই। যেদিন কাজে যেতে পারেন না, সেদিন হয়তোবা উপোস করেই দিনটা কাটাতে হয়।

ঠিক একই অবস্থা রাস্তার রিকশাওয়ালা বা অটোওয়ালা এবং রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়ে বসা সেদ্ধ ডিম বিক্রেতা বা কলা বিক্রেতারও। আরও আছেন ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষুকেরা। রিকশা নিয়ে বের হলেই জমার টাকা জোগাড় করতে হবে শুরুতে। এরপর নিজের দৈনিক খাওয়া–পরার খরচ। তারপর যদি কিছু বেঁচে থাকে, সেখান থেকে একেবারে সামান্য কিছু কিছু করে বাঁচিয়ে দেশে ফেলে আসা পরিবার–পরিজনকে পাঠানো। আমি জীবনে কোনো কিছুই দরদাম করে কিনতে পারিনি। কেন জানি দরদাম করার স্বভাবটা আমি কোনোভাবেই রপ্ত করতে পারিনি। কেউ কোনো দাম চাইলে, ভাই কম আছে কি না, শুধু এটুকুই বলি সব সময়। রিকশা ভাড়া করার বেলায়ও একই কথা। রিকশায় উঠে উনাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিই। একেকটা মানুষ কত শত স্বপ্ন নিয়ে উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছে। এই মানুষগুলোর সঙ্গে শুধু হাসিমুখে দুটো কথা বললে কি যে খুশি হন। আমি মাঝেমধ্যে বাসার সামনে নেমে উনাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বাসায় ঢুকে ফ্রিজের একটু ঠান্ডা পানি বা একটা কলা এনে দেয়। মানুষগুলো খুশিতে কেঁদে ওঠেন, কিন্তু বয়স্ক মানুষের কান্না ভালো জিনিস নয়। তাই উনাদের গলা ধরে আসে। আমি এই সময় আমার বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে করে নিয়ে আসি এবং বেশির ভাগ সময় ওকে বলি, পানি বা কলাটা শ্রমজীবী এই মানুষকে দিতে৷ আমি চাই ও খুব ছোটবেলা থেকেই মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখুক।

এ ছাড়াও ফুটপাতে নানা রকমের অগণিত ভ্রাম্যমাণ দোকান। সেখান থেকেও জীবিকা নির্বাহ করেন হাজারো মানুষ। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলে অনেক মানুষ এসে আমার–আপনার দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। আরও আছে ভিক্ষুক। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ঢাকা শহরের মূল জনসংখ্যার কত অংশ আমার জানা নেই, তবে তারা ঢাকা শহরের বিরাট একটা অংশ। তাদের কারণেই আমাদের জীবনযাপন কখনো কঠিন হয়েছে তো আবার কখনো সহজ হয়েছে। যেমন ফুটপাতে দোকান দেওয়ার ফলে সেটা দখল হয়ে যাওয়ায় রাস্তার একটা অংশ দখল করে মানুষ হাঁটা শুরু করেছে। ফলে জ্যাম বেড়েছে। আবার ফুটপাতের দোকান থেকে ঢাকা শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ সহজেই তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে পারছে। এ ছাড়াও ঢাকা শহরের রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ ঘর তুলে কত শত মানুষ যে বসবাস করে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। জীবন ধারণের সামান্য মৌলিক উপাদানও তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। তারা শুধু বেঁচে আছে বেঁচে থাকার জন্য। যতক্ষণ না কোনো মরণব্যাধি তাদের পরাস্ত করতে পারছে। তাদের দেখলে আপনি বুঝবেন জীবনে ঠিক কত সামান্যতে সুখী হওয়া যায়।

আমাদের ছোটবেলায় পড়া বিজ্ঞান বইয়ে বাস্তুসংস্থান নিয়ে কিছু কথা ছিল, যেখানে বলা ছিল জীবসমষ্টি পরস্পরের সঙ্গে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে। বাংলাদেশে যত বেশি উন্নয়ন হয়েছে, শ্রেণিব্যবধান ততই বেড়েছে দিনে দিনে। তবুও সবার সম্মিলিত অবস্থানে একটা বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে এবং মানুষ জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর সংস্থান করতে না পারলেও সুন্দরভাবে সহাবস্থান করছে। তাই ঢাকা শহরের সবচেয়ে দামি হোটেল সোনারগাঁওয়ের ঠিক পেছনেই একসময় ঢাকার অন্যতম বড় বস্তি ছিল। ঠিক একই অবস্থা গুলশান–বনানীরও। গুলশান–বনানীকে ধরা হয় বর্তমান ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা, কিন্তু ঠিক তার মাঝখানেই বিষফোঁড়ার মতো আছে কড়াইল বস্তি। এটাকে অনেকেই বিষফোঁড়া মনে করলেও সবাই জানে, কড়াইল বস্তি গুলশান–বনানীর মানুষের জীবনযাপনকে কতটা সহজ করে দিয়েছে। অপর দিকে কড়াইল বস্তিতে থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ সহজেই গুলশান–বনানী থেকে নিজেদের জীবিকা সংগ্রহ করতে পারছে।

আমার মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষক, পোশাক কারখানার মেয়েরা আর বিদেশে বাস করা প্রবাসীরা। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব যেকোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এত কম জায়গায় এত জনসংখ্যা থাকলে শুরুতেই যে প্রশ্ন মাথায় আসে, সেটা হলো কীভাবে সেই জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া হয়। বাংলাদেশের কৃষক রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে মানুষের মুখের আহারের ব্যবস্থা করছে। পোশাক খাতের নারীরা রাতদিন এক করে পরিশ্রম করে আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তিকে সচল রেখে চলেছে নামমাত্র বেতনের বিনিময়ে। যে বেতন দিয়ে মানুষ যে চলতে পারে, এটা হয়তোবা অনেকের কল্পনাতেই আসবে না। আর প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে দেশেই গেছেন, তাঁদের সততা ও পরিশ্রম দিয়ে সে দেশেরই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। আর দিন শেষে খাটুনির পয়সাটা দেশে থাকা স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর সব দেশই তাঁদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে মোকাবিলা করছে। এই ভাইরাস যেহেতু অতিদ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, তাই জীবনহানির সংখ্যাটা বেশ বড়। এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে তাই বিভিন্ন দেশ তাদের জনসাধারণকে যেকোনো জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলেছে। আমার কেন জানি মনে হয়, করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা গেলেও করোনা–পরবর্তী পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে, সেটা মোকাবিলা করতে আরও কয়েক দশক লেগে যাবে পৃথিবীর মানুষের।

এর আগেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করতে অনেক সময় লেগেছিল। যদিও বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে সেটার প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। এবারও হয়তোবা অতটা পড়বে না, কিন্তু ইতিমধ্যেই তৈরি পোশাকশিল্পের অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়েছে। যার ফলে বহু মানুষ রাতারাতি বেকার হয়ে যেতে পারেন। অবশ্য বিজিএমইর বর্তমান সভাপতি নিশ্চয়তা দিয়েছেন, কর্মীদের সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। এটা অবশ্যই অনেক শুভ উদ্যোগ।

যাইহোক, বাংলাদেশ সরকার অবশেষে স্কুল–কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে। আর পাশাপাশি ১০ দিনের সরকারি ছুটির ঘোষণা দিয়েছে। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার ফলে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে বহু মানুষ রাতারাতি বেকার হয়ে গেছে, যারা প্রতিদিন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। অন্যদিকে সরকারি ছুটি পেয়ে মানুষ ঈদের আনন্দ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। যার ফলে করোনা প্রতিরোধের যে প্রাথমিক ধাপ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সেটা লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখনো টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট। একটা সমাজব্যবস্থায় মানুষে মানুষে শিক্ষা, সামাজিকতা, অর্থনীতি, মানসিকতার এতটা তারতম্য বোধ হয় বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে বিভিন্ন কটূক্তিতে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আর যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের মনোভাব অনেকটা এমন যে দেশটাই উনাদের পৈতৃক সম্পত্তি। তাই উনারা যখন যা খুশি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং বদলাতেও পারেন। যাইহোক, দিন আনে দিন খায় মানুষগুলোর জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি কাজ করছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত অন্যান্য দেশের মতো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দেখা যায়নি। জানি না অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে কি না?

এবার আমরা একটু বহির্বিশ্বের দিকে নজর দিই। আমার মতে, করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে কানাডা। তারা বিভিন্ন রকমের ছাড় ও প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে এবং সেগুলো একে একে কার্যকর করতে উদ্যোগ নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে লক্ষণীয় বিষয় যে কেউই পুরোপুরি লকডাউন কার্যকর না করে একে একে বিভিন্ন সুবিধাদি বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি মানুষকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করছে। আমার মতে, সত্যিকার অর্থে পুরোপুরি লকডাউন সম্ভবও না। কাউকে না কাউকে ঘরের বাইরে যেতেই হবে বাকি মানুষগুলোর মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য। তন্মধ্যে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভূমিকা সবচেয়ে অগ্রগণ্য। উন্নত দেশে সবাই কোনো না কোনো কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করেন। একেবারেই হাতে গোনা কিছু মানুষ সরকারের কাছ থেকে ভাতা নিয়ে জীবন ধারণ করেন। তাই চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর ছেলেমেয়েদের আলাদাভাবে দেখভাল করার কেউ নেই। তাই হয়তোবা এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াতে স্কুলগুলো খোলা রাখা হয়েছে। আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যদি স্কুল বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমরা সমূহ বিপদে পড়ব। কারণ, আমার গিন্নি একজন চিকিৎসক। তাই তার ছুটির প্রশ্নই ওঠে না আর আমাদের অফিসও এখন পর্যন্ত খোলা আছে। অবশ্য অনেকেই যাঁরা ঘরে বসে সময় পার করেন, তাঁরা ফেসবুকে ধোঁয়া তুলেছেন সবকিছু পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার।

অস্ট্রেলিয়াতে ইতিমধ্যেই বহু মানুষ কর্ম হারিয়েছে এবং সেই সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এর ফলে নাগরিকদের সুবিধাদি নিশ্চিত করতে যে সেন্টারলিংক সার্ভিস, তার সামনে লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, এমনকি এই সার্ভিসগুলোর অনলাইন পোর্টাল ভেঙে পড়েছে আবেদনের সংখ্যার চাপ সামলাতে না পেরে। অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত বিশ্বের দেশে যেখানে নাগরিকের মৌলিক সুবিধাগুলোর নিশ্চয়তা দিতে রাষ্ট্র বদ্ধপরিকর, সেখানকার পরিস্থিতিই এখন ভয়াবহ, সেখানে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের যারা দিন আনে দিন খায় ভিত্তিতে জীবন যাপন করত তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।