না পড়লেন তো হেরে গেলেন

>
লেখালেখির দক্ষতা তৈরি করতে হলে প্রয়োজন পড়ার অভ্যাস
লেখালেখির দক্ষতা তৈরি করতে হলে প্রয়োজন পড়ার অভ্যাস
একসময় বলা হতো, বই হলো মনের খোরাক। পাঠ্যবইয়ের বাইরের সব বইকে বলা হতো ‘আউটবই’। এখন ‘আউটবই’–কে আর ‘আউট’ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। ক্যারিয়ারে সফল হতে হলেও বই পড়ার অভ্যাস আপনার থাকতেই হবে। কেন? শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন তাহমিদ উল ইসলাম

ক্যাম্পাসে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলছিলেন, ‘বই পড়ার অভ্যাস না থাকায় ভর্তি পরীক্ষায় লেখকদের নামগুলোও সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ে মুখস্ত করেত হয়েছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় নোটগুলো পড়তেও বেশ বেগ পেতে হয়। ’ এই শিক্ষার্থী ভেবেছিলেন, বই তো পড়তে হবে স্রেফ সৃজনশীল কাজের জন্য। আর লেখালেখির অভ্যাস করবে লেখকেরা। অন্য পেশাজীবীদের কেন লেখালেখি শিখতে হবে? অথচ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এসে তিনি উপলব্ধি করছেন, পড়ার অভ্যাস তাঁকে অনেকটাই এগিয়ে রাখতে পারত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা, বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য বই পড়ার অভ্যাসটা জরুরি। আবার পড়ার অভিজ্ঞতাই মানুষের লেখালেখির দক্ষতা তৈরির উপায়। হোক পেশাজীবন, গবেষণাপত্র লেখা কিংবা বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য আবেদন, আজকাল প্রায় প্রতি পদেই আপনার লেখার অভ্যাস কাজে লাগবে। বাংলার পাশাপাশি পড়তে হবে ইংরেজি বইও। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে কথাই বললেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা।

ভালো শিক্ষক হতে চাইলে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নাট্যকর্মী সামিনা লুৎফা। তিনি মনে করেন, একজন ভালো শিক্ষক হতে গেলে একজন ভালো মানুষ হওয়া দরকার, তাঁর জ্ঞান থাকা চাই সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থার সম্বন্ধে। আর সেই জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে বই পড়া, তাঁর ভাষায়, ‘পড়ার বইয়ের বাইরের বই পড়ার আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সাইনবোর্ড, টিন-ক্যানের লেবেল, সংবাদপত্র—সবকিছু পড়লেই আসলে সমাজকে, দেশকে এমনকি বিশ্বকেও বোঝা যায়। যে টি–শার্টটি পরে আছি, সেটার লেবেলে কোন দেশের নাম, সেটি জানা গেলে যেমন ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্বব্যবস্থার যোগাযোগ বোঝা যায়, তেমনি কবিতা-গল্প-উপন্যাস না পড়লে মানবতার অমূল্য সম্পদ আবেগ-অনুভূতি আর প্রেম ধরা–ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। মানুষ, প্রকৃতি আর জীবকুলের প্রতি প্রেম না থাকলে শিক্ষক কেন, মানুষই হওয়া যায় না। কাজেই বই না পড়লে কেমন করে হবে?’

বিদেশে পড়তে গেলে

বিদেশি ভাষায় লেখা বই পড়লে সেই ভাষার ওপরে দক্ষতা অর্জন করা যায়। আর সেই দক্ষতা কাজে লাগে ভাষাসংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষায়ও। এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুয়ারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সোমেশ্বরী পারমিতা বলেন, ‘আমি স্নাতক করেছি ভারতের ইউনিভার্সিটি অব মাইশোর থেকে। তখন হোস্টেলে একা একা থাকতাম। সারা দিন বই পড়তাম। এই পড়াটাই কাজে লেগেছে। নতুন নতুন শব্দ শিখেছি। লেখার স্টাইল শিখেছি। আইইএলটিএসের জন্য আলাদা করে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়নি।’ বলে রাখি, আইইএলটিএসে সোমেশ্বরীর স্কোর ছিল ৮। বৃত্তির জন্য আবেদন করতে হলে আজকাল বেশ কয়েকটি রচনা লিখতে হয়। আপনি যদি আপনার লেখার দক্ষতা দিয়ে কর্তৃপক্ষকে মুগ্ধ করতে পারেন, তাহলেই বৃত্তি পাওয়াটা অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় নানা ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা থাকার পরও শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েন শুধু লেখার দক্ষতা নেই বলে।

গবেষণায় বইপড়া

পড়ার অভ্যাস ও লেখার দক্ষতা কাজে লাগে গবেষণাপত্র লেখার কাজেও। এ বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা সংস্থার (আইএফপিআরপি) প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. নাজমুল আলমের সঙ্গে, তিনি বলেন, ‘গবেষণাপত্র লিখতে গেলে কাজে লাগে লেখার দক্ষতা; যা বাড়াতে গেলে বিভিন্ন লেখকের বই পড়ার বিকল্প নেই। ভিন্ন ভিন্ন লেখকের ভিন্ন ভিন্ন লেখনী, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন পড়ার ফলে পাঠকের চিন্তাভাবনার বিস্তৃতি ঘটে। গবেষণাপত্র লেখাটাও অনেক চিন্তার ফসল, যা সরল রূপে একজন গবেষক সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। সুতরাং বিভিন্ন লেখকের লেখার ধরনের সঙ্গে পরিচিত থাকলে গবেষণাপত্রের লিটারেচার রিভিউ, গবেষণার ফলাফলের সারসংক্ষেপ লিখতে সুবিধা হয়। তবে ভালোভাবে গবেষণাপত্র লেখার জন্য প্রচুর পরিমাণে ভালো ভালো জার্নালের গবেষণাপত্র পড়াটাও জরুরি।’

ভর্তি পরীক্ষার জন্য

আবদুল্লাহ সাদমান পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষায় ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা ছিল তাঁর। বই পড়া এবং ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়াকে কখনোই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। অনেকেই মনে করেন গল্প-উপন্যাস পড়া মানেই সময় নষ্ট। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পাঠ্যক্রমের বাইরের পড়াশোনা আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। অন্য অনেক ছাত্রছাত্রীর মতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খুঁটিনাটি আমাকে তোতাপাখির মতো মুখস্থ করতে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজের আগ্রহ থেকেই অনেক বই পড়েছিলাম আমি। আর এর ফলে অনেক প্রশ্নের উত্তরই সহজে করতে পেরেছিলাম। সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে গাইড বইয়ের সীমিত তথ্য সব সময় কাজে আসে না। সে ক্ষেত্রে গাইড বইয়ের বাইরের জ্ঞানকে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।’

উদ্যোক্তাদের বইয়ের জগৎ

উদ্যোক্তা হতে হলে সবার আগে প্রয়োজন উদ্ভাবনী চিন্তা আর সৃজনশীলতা। বই পড়ার অভ্যাস আপনাকে এই দুটো গুণই রপ্ত করতে সাহায্য করবে। উদ্যোক্তাদের বইপ্রীতির কথা তো মোটামুটি সবারই জানা। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ভীষণ বইয়ের পোকা। নিয়মিত বই তো পড়েনই, তাঁর ব্লগেও (www.gatesnotes.com) প্রিয় বইগুলো নিয়ে লেখেন। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ নিয়ম করে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে বই পড়েন। সফল উদ্যোক্তারা মনে করেন, উদ্যোগী মনোভাব তৈরি করতে হলে ভালো পাঠক আপনাকে হতেই হবে।