শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি এখনই দুই দিন করা কতটা যৌক্তিক

ফাইল ছবি

বিশ্বব্যাপী সংকটের কারণে দেশে জ্বালানি সাশ্রয়ে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। সময়সূচি দিয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দেওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি অফিসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার চেষ্টা চলছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার কথা ভাবছে সরকার; যদিও তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে প্রায় দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধের কারণে যে শিখনঘাটতি হয়েছে, সেটি পূরণের বিষয়ের ওপর যখন বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার চিন্তাভাবনা নিয়ে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ বলেছেন, এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা যৌক্তিক হবে না। বরং এখন শিখনঘাটতি পূরণে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন জরুরি। তবে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিখনঘণ্টা ঠিক করে আগামী বছর থেকে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা ঠিক আছে বলে তাঁরা মনে করেন।

আবার কারও অভিমত, সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন বাড়িয়ে দুই দিন করলে অ্যাসাইনমেন্ট (শিক্ষার্থীদের বাড়িতে নির্ধারিত কাজ দেওয়া) দিয়েও এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার বিষয়টি সামনে এসেছে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির এক বক্তব্য থেকে। গত শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা হচ্ছে। তবে এ মুহূর্তেই কোনো সিদ্ধান্তের কথা বলা যাচ্ছে না। হয়তো শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানানো যাবে।

এই মুহূর্তে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা যৌক্তিক হবে না। কারণ, শিখনঘাটতির বিষয়টি এখন স্পষ্ট। তাই এই ঘাটতি পূরণে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
এস এম হাফিজুর রহমান, মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে বন্ধের ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিল; যদিও এসব কার্যক্রমে সব এলাকার সব শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশ নিতে পারেনি।

করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনার মহামারিকালে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের (বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে) অর্ধেকেরও বেশির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মধ্যম ও উচ্চমাত্রায় শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা পূরণ করতে বলা হয় ওই গবেষণায়। তবে জেলা বিবেচনায় পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় পরিস্থিতি আরও খারাপ।

বেডুর এ গবেষণার তথ্য আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মাধ্যমে শিক্ষার ঘাটতি পূরণে বিস্তারিত একটি কর্মপরিকল্পনা করেছে। এটি এখন বাস্তবায়নের কথা। এনসিটিবি বলছে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলায় ১৫টি, ইংরেজিতে ১৭টি ও গণিতে ১৫টি মিলিয়ে মোট ৪৭টি অতিরিক্ত ক্লাস পরিচালনা করতে হবে। আর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে যেহেতু ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশি, তাই ওই সব এলাকার জন্য আরও বেশিসংখ্যক অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুন

শিক্ষাবিদেরা বলছেন, বেডু কেবল অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর গবেষণাটি করেছে। কিন্তু করোনাকালে শিখনঘাটতি হয়েছে প্রায় সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গ্রাম-শহরসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার চিন্তাভাবনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা যৌক্তিক হবে না। কারণ, শিখনঘাটতির বিষয়টি এখন স্পষ্ট। তাই এই ঘাটতি পূরণে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ ছাড়া ইতিমধ্যে বলা হয়েছে সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং কমে যাবে। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি এখন দুই দিন করে আবার আগের মতো করলে পাঠদানের সময়সূচিতে ঝামেলা হবে। তবে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে আগামী বছর থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার সিদ্ধান্তকে তিনি সমর্থন করেন।

জ্বালানি সমস্যার জন্য বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার এমন চিন্তাভাবনা করছে। যদি এটি হয়, তাহলে খুব বেশি সমস্যা হবে না। এক দিনের ঘাটতি অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েও পূরণ করা যাবে। করোনার সময়ও অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল।
অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন সাধারণত দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন। এ জন্য বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে এক দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকে।

আরও পড়ুন

এখনই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার চিন্তাভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি সমস্যার জন্য বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার এমন চিন্তাভাবনা করছে। যদি এটি হয়, তাহলে খুব বেশি সমস্যা হবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, এক দিনের ঘাটতি অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েও পূরণ করা যাবে। করোনার সময়ও অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল।