‘মাটির ময়না’ প্রথম; কোনো দ্বিতীয়, তৃতীয় নেই

রুবাইয়াত হোসেনআবদুস সালাম
বাংলাদেশি নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেনের তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। ছবিটি ইতিমধ্যে ফ্রান্স, পর্তুগাল আর ডেনমার্কে ৭০টির অধিক সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে। কুড়িয়েছে নানা পুরস্কার। গত বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় হোয়াটসঅ্যাপে কথা হলো ‘মেহেরজান’, ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এর এই নির্মাতার সঙ্গে।

প্রশ্ন :

আপনি নিউইয়র্কে?

না। নিউইয়র্কে ছিলাম। ওখানে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় একটু ভেতরে একটা গ্রামে এসে থাকছি। নিরিবিলি কাজ করছি।

২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়
ফেসবুক

প্রশ্ন :

উইমেন ইন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্টারন্যাশনালের (ডব্লিউআইএফটিআই) বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন।

ধন্যবাদ। ওরা যুক্তরাষ্ট্র, ওশেনিয়া, ইউরোপ, কানাডা, এশিয়া ও আফ্রিকা—এ ছয় অঞ্চল থেকে ১৬ জনকে নির্বাচন করেছে। বিশ্ব চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে সমতার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি।

আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য, আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সমতা আনা।
রুবাইয়াত হোসেন, নির্মাতা

প্রশ্ন :

ডব্লিউআইএফটি বাংলাদেশ কী?

উইমেন ইন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বাংলাদেশে নতুন শাখা খুলছে। তাসমিয়াহ আফরিন মৌ, হুমাইরা বিলকিস, ফৌজিয়া খান, এলিজাবেথ ডি কস্টা ও আমি প্রথমে ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলেছি। আপাতত ওখানে সংশ্লিষ্ট আগ্রহীরা জড়ো হচ্ছেন। পরে আমরা তাঁদের নিয়ে সিনেমার প্রদর্শনী করব, চিত্রনাট্য ও চিত্রগ্রহণের ওপর বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করব। আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য, আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সমতা আনা।

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সিনেমায় নেমায় নারী শ্রমিকদের সংগ্রাম ও ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলা হয়েছে।
প্রথম আলো

প্রশ্ন :

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এখন কোথায় চলছে?

২৮ আগস্ট (আজ) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দর্শক ছবিটি দেখতে পারবেন অনলাইনে। ৪০টি হলে ভার্চ্যুয়াল থিয়েট্রিক্যাল রিলিজ হবে। টিকিট কাটার পর ই–মেইলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছবিটির লিংক পাঠানো হবে। প্রাথমিকভাবে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছবিটি চলবে। দর্শকদের আগ্রহ থাকলে সময় বাড়ানো হবে। তা ছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সেও ছবিটি চলছে। সেখানকার পরিবেশক আমার ছবির ফরাসি প্রযোজক ফ্রাঁসোয়া দ্য আক্তেমেয়ারের কাছ থেকে ছবিটি কিনেছেন। এ ছাড়া চীন, জাপান ও পোল্যান্ডে ছবিটি মুক্তির কাজ চলছে।

আমি চাই, এই মানুষগুলোকে বড় পর্দায় দেখানো হোক। দর্শক মাথা উঁচু করে তাদের দেখুক। এটা একধরনের স্বীকৃতি।
রুবাইয়াত হোসেন, নির্মাতা

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের মানুষকে ছবিটি দেখানোর ব্যাপারে কী ভাবছেন?

আমি ছবিটা প্রথমে হলে মুক্তি দিতে চাই। সে জন্য সেন্সর সার্টিফিকেটের আবেদনের কাগজপত্র তৈরি করছিলাম। শুরু হলো করোনাকাল। সব আপাতত থেমে আছে।

আমার প্রথম ছবি ‘মেহেরজান’ নিয়ে একটা ‘হইচই’ পড়ে গেল, তখনো আমার পরিবার আমার পাশে ছিল। তবুও শুরুতে এ রাস্তায় চলা কঠিন ছিল
প্রথম আলো

প্রশ্ন :

অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মুক্তির কথা ভাবছেন?

আপাতত না। এ ছবির হিরো একজন পোশাককর্মী। তার সংগ্রাম আর জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প দেখানো হয়েছে এখানে। আমি চাই, এই মানুষগুলোকে বড় পর্দায় দেখানো হোক। দর্শক মাথা উঁচু করে তাদের দেখুক। এটা একধরনের স্বীকৃতি। তারপর ছবিটা হয়তো কোনো এক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দেওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে সেভাবে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠেনি। হলে মুক্তি দেওয়ার জন্য পরিচালককেই প্রচুর ঝক্কি পোহাতে হয়, যেটা মোটেও তাঁর কাজ নয়। আমি এসব করতে গিয়ে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। পরের ছবির কাজ বাধাগ্রস্ত হয়, পিছিয়ে যায়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বড় পর্দায় ছবিটি মুক্তি নিয়ে আমি একটু চিন্তায় আছি।

নির্মাতা হওয়া এমন একটা ‘জব’, যেখানে আপনাকে অনেক বেশি চলাফেরা করতে হবে। বাংলাদেশে সেটা কঠিন।
রুবাইয়াত হোসেন, নির্মাতা

প্রশ্ন :

এখন কী করছেন?

একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করলাম। আট মিনিট দৈর্ঘ্যের অমনিবাস ছবি। বিশ্বের ৪০টি দেশের ৪০ জন নির্মাতা এ ছবিতে তাঁদের দেশকে উপস্থাপন করবেন। আমি যেহেতু এখানে আছি, তাই শুরুতে আমাদের মার্কিন প্রযোজক অ্যালেন কুরাসকে না করে দিই। পরে তিনি আমাকে বোঝান যে এই সময়ে অনেকেই নতুন বাস্তবতায় দূর থেকে ছবি পরিচালনা করছেন। আমি রাজি হই। আমার চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, সাউন্ড ডিজাইনার ঢাকার আর কম্পোজার ডেনমার্কের। ১৫–১৬ বছর পর ভার্চ্যুয়ালি একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্য রকম আর নতুন। মেহেদী হাসানের ‘স্যান্ডসিটি’ ছবিটার ফান্ডিং ও আন্তর্জাতিক প্রযোজক যুক্ত করার জন্য আবেদন চলছে। আবিদ হোসেন খান পরিচালিত রোহিঙ্গা–সংকটের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘বিলংগিং’ (বাংলায় অবলম্বন) ছবিটার প্রযোজক আমরা (খনা টকিজ), সেটির সম্পাদনা চলছে। আর নতুন একটি ছবির চিত্রনাট্য লিখছি।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে নারী নির্মাতাদের কাজের পরিবেশ কেমন?

আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখনকার চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি একটু হলেও ভালো। এখন বেশ কিছু তরুণ নারী নির্মাতা ও প্রযোজক কাজ করছেন। এখন আমাদের সাদিয়া খালিদের মতো একজন নারী চলচ্চিত্র সমালোচক আছেন। আরও অনেকেই এ রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছুক। তবে নির্মাতা হওয়া এমন একটা ‘জব’, যেখানে আপনাকে অনেক বেশি চলাফেরা করতে হবে। বাংলাদেশে সেটা কঠিন। আমার পারিবারিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক—সব ধরনের সমর্থন ছিল। এমনকি আমার প্রথম ছবি ‘মেহেরজান’ নিয়ে একটা ‘হইচই’ পড়ে গেল, তখনো আমার পরিবার আমার পাশে ছিল। তবুও শুরুতে এ রাস্তায় চলা কঠিন ছিল। এখন যাঁরা আসছেন, তাঁদের ২০০ শতাংশ সংগ্রাম করে আসতে হচ্ছে, জায়গা করে নিতে হচ্ছে।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিটি আমার পছন্দের। একজন পুরুষের ছবিতে একজন পুরুষের ‘ম্যাসকুলিনিটি’র অবক্ষয় যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা দুর্দান্ত আর বিরল।
রুবাইয়াত হোসেন
রুবাইয়াত হোসেন
প্রথম আলো

প্রশ্ন :

তারেক মাসুদের মৃত্যুদিনে আপনি জানালেন, ‘মাটির ময়না’ এই ভূখণ্ডের সেরা ছবি। দ্বিতীয়, তৃতীয় সেরা ছবি কী?

‘মাটির ময়না’র যে সিনেম্যাটিক ক্র্যাফট, ঐতিহাসিক ছবি হিসেবে যে সংবেদনশীলতা, ভাবের গভীরতা, বিশালতা আর শৈল্পিক মান, আমি আর কোনো বাংলাদেশি সিনেমাকে এর আশপাশে রাখতে পারব না। তাই ‘মাটির ময়না’ প্রথম; কোনো দ্বিতীয়, তৃতীয় নেই। তবে এই মানের ছবি আমাদের দেশে আরও হবে। ২০০১ সালে ইয়াসমীন কবিরের ‘পরবাসী মন আমার’ ছবিটা দেখেছিলাম। ছবিটা আমার নির্মাতাসত্তাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তা ছাড়া মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিটি আমার পছন্দের। একজন পুরুষের ছবিতে একজন পুরুষের ‘ম্যাসকুলিনিটি’র অবক্ষয় যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা দুর্দান্ত আর বিরল।