নারী পাচারের ভয়ংকর চক্র, কেমন হলো ‘দিল্লি ক্রাইম ৩’
মাঝবয়সী এক নারী, দিল্লি পুলিশের ডিআইজি। শান্ত কিন্তু স্বভাবে দৃঢ়চেতা। পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক, ভেঙে পড়েন না। সিনেমা, সিরিজে দেখা অন্য পুলিশের মতো তাঁরও ব্যক্তিগত জীবনে টানাপোড়েন আছে, কিন্তু কাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় তিনি সব ভুলে যান। এই ‘তিনি’ আর কেউ নন, আলোচিত সিরিজ ‘দিল্লি ক্রাইম’-এর ‘ম্যাডাম স্যার’ ভার্তিকা চতুর্বেদী। ২০১৯ সালে নেটফ্লিক্সে ‘দিল্লি ক্রাইম’-এর প্রথম কিস্তি মুক্তির পর হইচই পড়ে যায়। দিল্লির আলোচিত নির্ভয়া ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিরিজটি ছিল আর দশটি ভারতীয় সিরিজের চেয়ে এগিয়ে।
একনজরে
সিরিজ: ‘দিল্লি ক্রাইম ৩’
ধরন: ক্রাইম-ড্রামা
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
পরিচালনা: তনুশ চোপড়া
অভিনয়: শেফালি শাহ, রসিকা দুগ্গল, রাজেশ তাইলং, হুমা কুরেশি, গোপাল দত্ত
পর্ব সংখ্যা: ৬
রানটাইম: ৪৫-৫৫ মিনিট
পরে সিরিজটি জিতে নেয় আন্তর্জাতিক এমি অ্যাওয়ার্ডসও। ২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া দ্বিতীয় মৌসুম প্রথমটির মতো না হলেও মন্দ ছিল না। তিন বছর বিরতির পর ১৩ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছে এর তৃতীয় কিস্তি। মুক্তির পর থেকেই সিরিজটি নিয়ে তুমুল আলোচনা অন্তর্জালে। কেমন হলো ভার্তিকা চতুর্বেদী ওরফে ‘ম্যাডাম স্যার’-এর প্রত্যাবর্তন।
তৃতীয় মৌসুমের গল্প নারী পাচার নিয়ে। ভারতের নানা প্রান্তে নারী ও শিশুদের পাচারের পেছনে কাজ করে বড় একটি চক্র। নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য পাচার করা হয় বাইরে, শিশুদের দিয়ে করানো হয় ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা অমানবিক কাজ। ‘দিল্লি ক্রাইম ৩’-এর প্রেরণা বেবি ফালকের কেস। ২০১২ সালে এক শিশুকে গুরুতর আহত অবস্থায় দিল্লির হাসপাতালে ফেলে যান এক নারী। সেই সত্য ঘটনার প্রেরণায় শুরু এবারের মৌসুম। এই ঘটনা যখন দিল্লিতে ঘটে, ভার্তিকা (শেফালি শাহ) তখন বদলি হয়ে গেছেন উত্তর-পূর্ব ভারতে। তাঁকে যে শাস্তি হিসেবে বদলি করা হয়েছে, বলাই বাহুল্য।
দিল্লির হাসপাতালে যখন এক নারী অসুস্থকে শিশুকে রেখে চলে যান, একই সময়ে ভার্তিকা একটি ট্রাক আটক করেন; যে ট্রাকে করে নারীদের দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ঘটনার উৎস সন্ধানে তিনি হাজির হন দিল্লিতে। এদিকে সেই ফেলে যাওয়া শিশু নূরের ঘটনার তদন্ত করছিলেন এসিপি নীতি সিং (রসিকা দুগ্গল)। ঘটনাক্রমে ভার্তিকা আর নীতির কেসে যোগসূত্র পাওয়া যায়, জানা যায় নারী পাচার চক্রের পেছনে আছেন বড় দিদি (হুমা কুরেশি)। কে এই বড় দিদি? শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস এক অভিযান। এই অভিযানে আগের মতোই থাকেন ইন্সপেক্টর ভূপেন্দ্র (রাজেশ তাইলাং), সাব-ইন্সপেক্টর সুধীর (গোপাল দত্ত)।
এবার ‘দিল্লি ক্রাইম’ দিল্লি ছাড়াও আসাম, মণিপুর, হরিয়ানা, মুম্বাই আর গুজরাটে বিস্তৃত হয়েছে; তবে গল্পের ডিএনএ এখনো দিল্লি। সিরিজের মূল সূর, পুলিশ টিম আর জটিলতা আগের মতোই। তবু আগের দুই মৌসুমের তুলনায় তৃতীয় কিস্তি অনেকটাই ম্লান। একটি সফল সিরিজের একের পর এক নতুন মৌসুম এলে সেটার মান ধরে রাখা কঠিন বটে। নির্মাতা বদলালেও, দ্বিতীয় মৌসুম সততা ধরে রেখেছিল। বরং দিল্লি পুলিশের চরিত্রগুলোকে আরও মানবিকভাবে দেখিয়ে প্রথম মৌসুমের সমালোচনার অনেকটাই ধরতে পেরেছিল সিরিজটি। কিন্তু তৃতীয় মৌসুম এসে খেই হারাল বহুল চর্চিত সিরিজটি।
কাগজে-কলমে তৃতীয় কিস্তির ধারণাগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী কিন্তু বাস্তবে সেটা ঠিকঠাক নির্মাতা দেখাতে পারলেন কই। এবার যেন তিনি একটু বেশিই ‘সেফ’ খেলেছেন। ধরেই নিয়েছেন, যা–ই করবেন, দর্শকেরা গ্রহণ করবেই। এই সিরিজের মূল সুর ছিল মানবিকতা। পুলিশকে নায়কোচিতভাবে তুলে না ধরে বরং বাস্তবসম্মতভাবে হাজির করা; তাঁদের ঘষ্টা খাওয়া দৈনন্দিন জীবন তুলে ধরা। কিন্তু এবার যেন শুরু থেকেই নির্মাতারা পণ করেছেন তিনি পদে পদে বুঝিয়ে দেবেন তাঁরা (পুলিশ সদস্যরা) কেন আলাদা। এই সিরিজে তদন্তের চেয়ে বরং অপরাধীদের মনোজগতের চৌহদ্দিতে দর্শকদের ঘুরিয়ে আনেন নির্মাতা। একজন কেন অপরাধী হয়, সেটা তুলে ধরেন। কিন্তু এবারের মৌসুমে এই মৌলিক বিষয়টিই অনুপস্থিত।
নির্মাতারা ভরসা রেখেছেন নানা ‘গিমিক’-এর ওপর। চিত্রগ্রহণে অতিরিক্ত ক্লোজআপ যা শুরুতে প্রতীকী মনে হলেও পরে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। ডায়ালগে অতিরিক্ত অলংকার (নোবডি মিসেস মিসিং গার্লস’, ‘আই অ্যাম অ্যালোন, বাট নট লোনলি) সিরিজটিকে বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
চরিত্রগুলোর ওপর কাজও অসম্পূর্ণ। রসিকা দুগ্গলের নীতির চরিত্রে মাতৃত্বের টানাপোড়েন ফুটে ওঠে বটে, কিন্তু অন্যদের ক্লান্তি বা মানসিক চাপ তেমন বোঝা যায় না। শেফালি শাহ অভিনীত ভার্তিকা চরিত্রেও এবার যেন চেনা ছকে ঢুকে পড়েছে। স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য টানাপোড়েন দেখানো হলেও সেটি কোথাও গিয়ে থামে না।
সবচেয়ে হতাশ করেছে খলনায়কদের চরিত্র নির্মাণে। খল চরিত্রদের শুরু থেকেই রহস্যহীন। মীনা ওরফে বড় দিদি চরিত্রটি খলনায়ক হিসেবে বড্ড দুর্বল, কেন, কীভাবে সে এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠল, সে গল্প জানাই হয় না। একইভাবে কুসুম (সায়নী গুপ্ত) আর বিজয় (সানু ডি নিশ) চরিত্র দুটোর গভীরতা নেই। এ ছাড়া সব রহস্য খুব সহজেই সমাধান হয়ে যায়, যখন যে ক্লুর দরকার; ঠিকঠাক চলে আসে পুলিশের হাতে। সবচেয়ে হতাশার ক্ল্যাইম্যাক্স। শেষে কী হতে যাচ্ছে, অনুমিতই ছিল কিন্তু এতটা সাদামাটা হবে; সেটাও বা কে ভেবেছিল!
‘দিল্লি ক্রাইম’ আর ‘পাতাললোক’-এ অপরাধ আর পুলিশি তদন্তের আড়ালে ছিল রাজনৈতিক বার্তা। ‘ছিল’ কারণ এবার নির্মাতারা সচেতনভাবেই ‘অরাজনৈতিক’ থেকেছেন। গত কয়েক বছরের ওটিটির বিভিন্ন সিনেমা-সিরিজ নিয়ে প্রবল বিতর্ক, রাজনৈতিক চাপ, মামলার কারণেই এটা হয়েছে, সেটা সহজেই বোধগম্য। তাই ওটিটিতে ফি সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া অন্য ক্রাইম-ড্রামার চেয়ে ‘দিল্লি ক্রাইম ৩’-কে আলাদা করা কঠিন। ভারতে নারী নির্যাতনের বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্দায় হাজির করে ব্যাপাটাকে আরও ক্লিশে করে তুলেছেন নির্মাতারা।
আগের দুই কিস্তি দেখা না থাকলে তৃতীয় মৌসুম খারাপ লাগবে না। কিন্তু তুলনা করতে গেলেই হতাশ হবেন। এমনিতে কেবল অভিনয়ের জন্যই সিরিজটি একবার দেখা যায়। অভিনয়ে সবাই দারুণ। শেফালি শাহ, রসিকা দুগ্গল, রাজেশ তায়লাং, জয়া ভট্টাচার্য, অনুরাগ অরোরা, মিতা বলিষ্ঠ ও গোপাল দত্ত নিজেদের জায়গায় ভালো করেছেন। মীনা ওরফে বড় দিদি চরিত্রে হুমাও মন্দ নন। তবে চরিত্র ঠিকঠাকভাবে লেখা না হলে তাঁর আর কী-ইবা করার আছে!
ঢাকায় কোনো বিরিয়ানির দোকান সাফল্য পেলে একই নামে বা কাছাকাছি নামে শহরের নানা প্রান্তে সেটার অনেক নকল শাখা চালু হয়। তৃতীয় মৌসুম দেখার পর আপনারও মনে হতে পারে, এটা আসল “দিল্লি ক্রাইম” তো!