‘পাতাললোক’ থেকে ‘ফ্যামিলি ম্যান’ এবার অভিযান নাগাল্যান্ডে

‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’–তে দেখা গেছে নিমরাত কৌর, মনোজ বাজপেয়ী ও জয়দীপ আহালওয়াতকে। কোলাজ

হঠাৎই হিন্দি ওয়েব সিরিজগুলো উত্তর-পূর্ব ভারতমুখী হয়ে উঠেছে! ২০২২ সালে অনুভব সিনহার সিনেমা ‘অনেক’ খুলে দিয়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের দরজা। এর পর থেকে একে একে সব হাই প্রোফাইল সিরিজ ঢুকে পড়েছে সেই দরজা দিয়ে। ভারতের এই অঞ্চলের গল্প বরাবরই মূলধারার হিন্দি সিনেমায় অবহেলিত ছিল। কিন্তু অতিচর্চায় সেটা আবার নষ্ট হয়ে যাবে না তো? ‘পাতাললোক ২’, ‘দিল্লি ক্রাইম ৩’-এর পর এবার ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর তৃতীয় মৌসুমের প্রেক্ষাপট উত্তর-পূর্ব ভারত। রহস্য এবার দানা বেঁধেছে নাগাল্যান্ডে। বহুল চর্চিত সিরিজটির তৃতীয় কিস্তি এসেছে অ্যামাজন প্রাইমে, কেমন হলো নতুন মৌসুম?

একনজরে
সিরিজ: ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’
নির্মাতা: রাজ ও ডিকে
ধরন: স্পাই-থ্রিলার
অভিনয়ে: মনোজ বাজপেয়ী, প্রিয়ামণি, শারিব হাশমি, শ্রেয়া ধন্বন্তরী, নিমরত কৌর ও জয়দীপ আহালওয়াত।
স্ট্রিমিং: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও
পর্ব সংখ্যা:
রানটাইম: ৫০-৫৪ মিনিট

দিল্লি ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের ঐতিহাসিক বৈঠক ঘিরে তৈরি হচ্ছে উত্তেজনা। এই ‘মূল ভূখণ্ড’ ও ‘প্রান্তিক অঞ্চল’-এর মুখ হয়ে উঠেছে নাগাল্যান্ড। এই অঞ্চলে বহু বিভাজন—একদিকে সরকারকে অবিশ্বাস করা বিদ্রোহী গোষ্ঠী, অন্যদিকে শান্তির পক্ষে থাকা প্রবীণ রাজনীতিকেরা। বৈঠকে যাওয়ার জন্য এক গাড়িতে রওনা হন শ্রীকান্ত তিওয়ারি (মনোজ বাজপেয়ী), গৌতম কুলকার্নি (দীলিপ তাহিল) ও ডেভিড খুজা (সুনীল থাপা)।

এই শান্তিচুক্তি থামাতে মরিয়া লন্ডনে থাকা রহস্যময় এক নারী মীরা এস্ট (নিমরাত কৌর)। কারণ, এতে এক বিলিয়নিয়ারের সঙ্গে লাভজনক অস্ত্রচুক্তি আটকে যায়, মন্ত্রিসভা অসন্তুষ্ট হয়। মীরা আইএসআই এজেন্ট মেজর সামীরের (দর্শন কুমার) সাহায্যে বৈঠক থামাতে দায়িত্ব দেন নাগাল্যান্ডের মাদক সর্দার রুকমাকে (জয়দীপ আহালওয়াত)। রুকমার অভিযানে সবাই মারা যান, কেবল শ্রীকান্ত কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান।

‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’–এর দৃশ্যে মনোজ বাজপেয়ী। এক্স থেকে

প্রধানমন্ত্রী বাসু (সীমা বিশ্বাস) নড়েচড়ে বসেন। কী হবে এবার? এদিকে প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, এই হামলায় জড়িত খোদ শ্রীকান্ত তিওয়ারি; তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। অবস্থা বেগতিক বুঝে স্ত্রী শুচি (প্রিয়ামণি), দুই সন্তান অথর্ব ও ধৃতি এবং জেকে (শারিব হাশমি) নিয়ে পালান তিনি। গন্তব্য নাগাল্যান্ড, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে তো বটেই, সঙ্গে বাঁচাতে হবে দেশকে আর নিতে হবে কুলকার্নি স্যারের মৃত্যুর প্রতিশোধ। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, স্থানীয় বিভাজন, মাদক ব্যবসায়ী, বিদেশি শক্তি, গোপন বাণিজ্যিক স্বার্থ, ঐতিহাসিক ক্ষত, বিশ্বাসঘাতকতা মিলিয়ে এগিয়ে যায় গল্প।

ওপর থেকে দেখলে আসলে ‘পাতাললোক’-এর দ্বিতীয় মৌসুমের কথাই বেশি মনে করিয়ে দেয়। চার বছর পর আসা ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’ যেন অদ্ভুতভাবে একই প্ল্যাটফর্মের আরেকটি সিরিজ ‘পাতাললোক ২’-এর ইউনিভার্সে ঢুকে গেছে। কাকতালীয়ভাবে দুই সিরিজেই আছেন জয়দীপ, একটিতে তিনি ত্রাতা; অন্যটিতে আততায়ী। তবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই সময়ের হিন্দি সিনেমা ও সিরিজে ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলের প্রতি আগ্রহ কোনো কাকতাল নয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চল এখন হয়ে উঠেছে সরকারবিরোধী ক্ষোভ, আইটি সেল আর নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের গল্প বলার নতুন বাহন। কাশ্মীর নিয়ে গল্প বলা এখন জটিল হয়ে উঠেছে বলেই সম্ভবত এই প্রবণতা।

‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’–এ জয়দীপ আহালওয়াত। অ্যামাজন প্রাইমের ইনস্টাগ্রাম থেকে

কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে কেবল ‘বিকল্প’ হিসেবে দেখলে সেখানে নিপীড়নের বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা হয়। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ ২০১৯ থেকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে—প্রথম মৌসুমে ইসলামোফোবিয়া ও উগ্রবাদ, দ্বিতীয় মৌসুমে এলটিটিই বিদ্রোহ; ফলে তৃতীয় মৌসুমে পূর্বমুখী হওয়াটা স্বাভাবিক, তবে প্রেক্ষাপট এখন আর নতুন মনে হয় না।

নির্মাতা দ্বয় রাজ ও ডিকে তাঁদের ওয়ান টেক শটের জন্য পরিচিত; এবারের মৌসুম শুরুই একেকটা দীর্ঘ ওয়ান টেক শট দিয়ে। ক্যামেরা ঘুরে বেড়ায় নাগাল্যান্ডের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভেতর, ভিড়ের মধ্যে বোমা পুঁতে রাখা হয়। আগের দুই মৌসুমেও এমন দৃশ্য ছিল, তবে সেগুলো ছিল সিরিজের মাঝপথে এবং অবশ্যই অ্যাকশন দৃশ্য। এবার শুরুতেই দর্শককে চমকে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু এই চমক পরে আর ধরে রাখতে পারেননি নির্মাতারা। ধীরে ধীরে সিরিজটি চেনা ফর্মুলার ফাঁদে পড়ে।

‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’–এর দৃশ্য। অ্যামাজন প্রাইমের ইনস্টাগ্রাম থেকে

এবার মৌসুমটি এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সবচেয়ে দুর্বল, তবে স্পাই-থ্রিলার হিসেবে এখনো চলনসই। শ্রীর গালাগালি, মিথ্যা বলা, জেকের সঙ্গে তাঁর খুনসুটি, অবহেলিত স্ত্রী সূচিকে (প্রিয়ামণি) দেওয়া অজুহাত—সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের চেনা ছবি। আগের চেয়ে চরিত্র নির্মাণ দুর্বল হলেও ‘মিডল ক্লাস ম্যান, ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্পাই’ হিসেবে শ্রীকান্ত উতরে যান। চলন্ত ট্রেনে মেয়ের প্রশ্নে শ্রীকান্ত যখন বলেন, ‘আমাদের মতো এজেন্টদেরও কি স্ত্রী-সন্তান পাওয়ার অধিকার নেই?’ তখন সিরিজের মূল সুরটি স্পষ্ট হয়। ক্ষোভ, হতাশা, অসহায়ত্ব আর মজার দৃশ্যগুলোতে আগের মতোই দুর্দান্ত মনোজ, তবে তাঁকে ঠিক অ্যাকশনে খুব বেশি দেখা গেল না, এটাই বড় আফসোস।

খল চরিত্রে রুকমা বহুমাত্রিক—গ্যাংস্টার, ঠিকাদার ও হতাশ দেশপ্রেমিক। তাঁরও ইচ্ছা হয় বিয়ে করে পারিবারিক মানুষ হয়ে উঠতে। এই চরিত্রে মনে রাখার মতো কাজ করেছেন জয়দীপ। সাবেক নাগামিজ সৈনিক হিসেবে অনবদ্য। তিনি একদিকে কঠিন অপরাধী, আবার একধরনের নীতিবোধসম্পন্ন নরম মানুষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তিনি বহিরাগত হয়েও সম্মান আদায় করে নেন, মূল ভূখণ্ডের প্রতি স্থানীয় লোকজনের বিরাগ থাকা সত্ত্বেও। তবে কেন তিনি ‘বিপথগামী’ হলেন, কোথাও সেটা দেখানোর প্রয়োজন মনে করেননি নির্মাতা।

এই মৌসুমে হাজারো সমস্যা। চিত্রনাট্য দুর্বল, সেই দুর্বলতা ঢাকতে গল্প কেবল এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। জটিলতার মূলে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যাপার, কিন্তু সেটার উপস্থাপনা বড্ড ক্লিশে। আগের মৌসুমগুলোতে বিভিন্ন তথ্য বিনোদনের মোড়কে দৃশ্যের ভেতরে গেঁথে দেওয়া হতো। এবার সংলাপভিত্তিক ব্যাখ্যা বেড়েছে, ঠিক নির্মাতাদ্বয়ের আরেকটি সিরিজ ‘সিটাডেল: হানি বানি’-এর মতো। যেন দর্শককে গুলিয়ে খাইয়ে না দিলে তাঁরা কিছুই বুঝবেন না।

সিরিজটি আসলে এমন একজন মধ্যবিত্ত মানুষের গল্প, যিনি রাষ্ট্রের চাকরিতে এতটাই ‘প্রতারক’ হতে বাধ্য হন যে তাঁর দাম্পত্য দাঁড়িয়ে থাকে অবিশ্বাসের ওপর। রুকমার ক্ষেত্রে সেটা আরও করুণ—তিন সেই সুযোগটুকুও পান না। মীরা, ইয়াতিশসহ (হারমান সিং) অন্য চরিত্ররাও ধূসর। এখানে কেউ পুরোপুরি খারাপ নন, সবাই পুরোপুরি ভালোও নন—এই সিরিজের আগের মৌসুমে যেমনটা দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

জেকে শারিব হাশমি এখনো বেশ ভালো, তবে এবারের মৌসুমে শ্রীকান্তের সঙ্গে তাঁর রসায়ন সেভাবে জমেনি। তাঁদের মজার মুহূর্তগুলো ছিল আগের মৌসুমগুলোর বড় প্রাপ্তি। এবারও তাঁরা অনেক কথা বললেন, কিন্তু সেভাবে হাসি পেল কই? শুচি চরিত্রে প্রিয়ামণির তেমন কিছু করার ছিল না। মীরা চরিত্রে নিমরাত কৌর কেবল লন্ডনের রাস্তায় ফোন হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’–এর পোস্টার। অ্যামাজন প্রাইমের ইনস্টাগ্রাম থেকে

জোয়া চরিত্রে আবার ফিরেছেন শ্রেয়া ধন্বন্তরী; তাঁর কাজ চলনসই। তবে নতুন এজেন্ট চরিত্রে হতাশ করেছেন হারমান সিং। তাঁর অ্যাকশন, আবেগের বা রোমান্টিক দৃশ্য কোনোটাই মনে দাগ কাটে না। এ ছাড়া রাজ আর ডিকের ইউনিভার্সের সুপরিচিত দুই চরিত্র আছেন, কিন্তু তাঁদের দেখে ঠিক হাততালি দিতে ইচ্ছা করে না।
এই মৌসুমে হাজারো সমস্যা। চিত্রনাট্য দুর্বল, সেই দুর্বলতা ঢাকতে গল্প কেবল এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। জটিলতার মূলে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যাপার, কিন্তু সেটার উপস্থাপনা বড্ড ক্লিশে। আগের মৌসুমগুলোতে বিভিন্ন তথ্য বিনোদনের মোড়কে দৃশ্যের ভেতরে গেঁথে দেওয়া হতো। এবার সংলাপভিত্তিক ব্যাখ্যা বেড়েছে, ঠিক নির্মাতাদ্বয়ের আরেকটি সিরিজ ‘সিটাডেল: হানি বানি’-এর মতো। যেন দর্শককে গুলিয়ে খাইয়ে না দিলে তাঁরা কিছুই বুঝবেন না।

আরও পড়ুন

রাজনৈতিক ভাষ্যও দ্বিধাগ্রস্ত। প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়ায় সহানুভূতি, পুরুষ সহকারীদের দোষ—ফোকাস চলে যায় আদর্শগত বিষয় থেকে লিঙ্গ প্রসঙ্গে। মিডিয়া সংস্কৃতি এখানে এক বিকল্প বাস্তবতায় কাজ করে, যেখানে টিভির সঞ্চালকেরা সরকারকে আক্রমণ করেন। টুইস্টগুলোও আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়।

‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’–এ নিমরাত কৌর। অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও

সবচেয়ে হতাশার শেষ ক্লিফহ্যাঙ্গার—অসম্পূর্ণ মনে হয়। চলতি মাসে নেটফ্লিক্সের আসা ‘দিল্লি ক্রাইম ৩’–এর ক্লাইমেক্সের মতো হতাশ না করলেও আগের দুই মৌসুমের তুলনায় জমেনি। বড় আকর্ষণ হতে পারত ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এর বাবা-ছেলে জুটিকে (মনোজ বাজপেয়ী ও জয়দীপ আহলাওয়াত) মুখোমুখি দেখা; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর জমল কই!

আগের দুই মৌসুম মনে রাখলে তাই ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান ৩’ অনেক পিছিয়ে। তবে দারুণ নির্মাণ, হাস্যরস, রোমাঞ্চ, মনোজ বাজপেয়ী আর জয়দীপের অভিনয় মিলিয়ে স্পাই-থ্রিলার হিসেবে একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়।