ভাঙাগড়ায় মেকানিক্সের দুই দশক
পথচলার দুই দশক পূর্ণ করেছে রক ব্যান্ড মেকানিক্স। এ উপলক্ষে দেশজুড়ে কনসার্টে ব্যস্ত আছে ব্যান্ডটি। মেকানিক্সের পথচলা ও পরিকল্পনা শুনেছেন নাজমুল হক
সময়টা ২০০৫ সাল। ক্যারিয়ার ও জীবনের নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিতেন দুই বন্ধু আফতাবুজ্জামান ত্রিদিব ও শেখ রিয়াজ। আড্ডায় ঘুরেফিরে আসত সংগীতের কথা। একসময় তাঁরা ভাবলেন, এমন একটি ব্যান্ড গড়বেন, যেটি সমাজ ও দেশের কথা বলবে, যেখানে থাকবে তাঁদের জীবনধারা ও চিন্তাভাবনার প্রতিচ্ছবি।
সে বছরের ২৩ নভেম্বর ধানমন্ডির মিউজিক ম্যানিয়ায় প্রথম প্র্যাকটিস সেশন করেন তাঁরা। ত্রিদিব (ভোকাল), রিয়াজের (ড্রামস) সঙ্গে যোগ দেন রুশো খান (বেজ) ও তামজীদ খান (গিটার)। এক মাসের মধ্যেই ব্যান্ডে যোগ দেন গিটারিস্ট ইমরান আহমেদ—এভাবেই জন্ম নেয় মেকানিক্স।
প্রথম ছয় মাস টানা প্র্যাকটিসে কাটে। ব্যান্ডের সদস্যদের শপথ ছিল—নিজেদের শতভাগ না দেওয়া পর্যন্ত কোনো কনসার্ট নয়। ত্রিদিব বলেন, ‘এই কঠিন সিদ্ধান্তের কারণেই আমাদের প্রথম শো থেকে আজ পর্যন্ত কখনো কনসার্ট খুঁজতে হয়নি, বরং কনসার্টই আমাদের খুঁজে নিয়েছে।’
পরিচিতি ‘ডি রকস্টার’ থেকে
২০০৭ সালে ডি রকস্টারের দ্বিতীয় সিজনে অংশ নেয় মেকানিক্স। সেমিফাইনালে থামলেও দেশজুড়ে পরিচিতি পায় তারা। ত্রিদিব বলেন, ‘শুরুতে আমাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না। ভাবতাম, এই ঘরানার গান হয়তো সাধারণ শ্রোতা নেবে না।’ অডিশন রাউন্ডে বিচারক শাফিন আহমেদ, এরশাদ জামান ও টনি (ব্ল্যাক) তাঁদের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করেন। ত্রিদিব স্মরণ করেন, ‘শাফিন ভাই স্টেজ থেকে নেমে এসে আমাদের সঙ্গে হাত মেলালেন। তখনই মনে হয়েছিল, উই ক্যান ডু ইট! পর্বটি প্রচারের পর দেখি, সারা দেশ আমাদের নিয়ে কথা বলছে।’ মূল প্রতিযোগিতায় বিচারক বেজবাবা সুমন ও পার্থ বড়ুয়া তাঁদের পাশে ছিলেন। সেই সময়ের ‘কালো বিক্ষোভ’ ও ‘অপরাজেয়’ গান দুটি শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া তোলে।
ভাঙাগড়ার গল্প
ব্যান্ডজগতে ভাঙা-গড়া স্বাভাবিক, তবে মেকানিক্সের জন্য সেটা ছিল কঠিন বাস্তবতা। ২০০৮ সালে প্রথম অ্যালবাম অপরাজেয়-র কাজ শুরুতেই ব্যান্ড ছাড়েন ইমরান আহমেদ। যোগ দেন জেহীন আহমেদ। পরের বছর ইকবাল আসিফ জুয়েল-এর মিক্সড অ্যালবাম রক ২০২-এ প্রকাশিত হয় মেকানিক্সের প্রথম গান ‘ধ্রুবসর’, যা এখনো ব্যান্ডটির সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর একটি।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রুশো ব্যান্ড ছাড়েন। তাঁর জায়গায় বেজিস্ট হিসেবে যোগ দেন নাদভী ওয়ালিদ। এই লাইনআপ নিয়েই ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় মেকানিক্সের প্রথম অ্যালবাম ‘অপরাজেয়’ ডেডলাইন মিউজিকের ব্যানারে।
কঠিন সময়ের লড়াই
২০১৩ সাল মেকানিক্সের জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। ব্যক্তিগত কারণে ব্যান্ড ছাড়েন গিটারিস্ট তামজীদ, আর বিদেশে চলে যান নাদভী। ব্যান্ডের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেন শাহেদ (গিটার) ও তানিম পাবেল (বেজ)। ২০১৪ সালে রক টেন মিক্সড অ্যালবামে প্রকাশিত হয় তাঁদের গান ‘এলিজি’, যা শ্রোতাদের মধ্যে প্রশংসা পায়।
কনসার্টে ব্যস্ত সময়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন জেহীন আহমেদ। পাকস্থলীর জটিলতা ও শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছিলেন তিনি। কিছুদিন গেস্ট মেম্বারদের নিয়ে পারফর্ম করে ব্যান্ড। পরে ২০১৬ সালে জেহীন কিছুটা সুস্থ হলে আবার মঞ্চে ফেরে মেকানিক্স। সেই সময় বেজে আবার যোগ দেন নাদভী, আর গিটারিস্ট শাহেদের জায়গায় আসেন সাফাত চৌধুরী। ত্রিদিব, জেহীন, রিয়াজ, সাফাত ও সালেক—এই পাঁচজন মিলে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করেন।
জেহীনের চিরবিদায়
২০১৭ সালের ২২ জুলাই—মেকানিক্সের জন্য এক শোকের দিন। এদিন মারা যান গিটারিস্ট জেহীন আহমেদ। তখন ব্যান্ডের কার্যক্রম অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ত্রিদিব বলেন, ‘জেহীনের চলে যাওয়াতে আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। এও মনে হচ্ছিল, মেকানিক্স থেমে গেলে আমরা নিজেরাও হয়তো টিকে থাকতে পারব না। তখন আবার নতুন করে ব্যান্ডের কার্যক্রম শুরু করি।’
পরে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, জেহীনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবার শুরু করবেন। নতুনভাবে ব্যান্ডে যোগ দেন গেস্ট মেম্বার শুভ্র। জেহীনসহ সাবেক সদস্যদের স্মরণ করে প্রকাশিত হয় গান ‘নিয়তি’, যা শ্রোতাদের কাছে গভীরভাবে পৌঁছায়।
সংকট কি শেষ হলো
নাহ, ভাঙা-গড়ার এ খেলা শেষ হয়নি। ২০১৮ সালের শেষের দিকে মেকানিক্স ছাড়েন সালেক। আর একক ক্যারিয়ারের মনোযোগ দিতে ব্যান্ড ছাড়েন শুভ্র। এরপর ২০১৮ সালের শেষের দিকে গিটারে সাইফ ইরফান এবং বেজিস্ট হিসেবে যোগ দেন সৌমিক ইসলাম। ত্রিদিব বলেন, ‘সাইফ আর সৌমিককে পেয়ে যেন আশার আলো দেখতে পাই। সাইফের সঙ্গে আমাদের কেমিস্ট্রি ছিল অনেক আগে থেকেই। সে একজন অসাধারণ গিটারিস্ট। আর সৌমিক অত্যন্ত দক্ষ মেটাল প্লেয়ার। এখন এই লাইনআপেই আছি আমরা। আমাদের ব্যবস্থাপক মিঠুন হাসানের কথা বলব, ২০১৫ সাল থেকে আমাদের এই জার্নিকে অনেক সহজ করেছেন তিনি।’
দুই দশকের উদ্যাপন
২০ বছর পূর্তিতে দেশজুড়ে চলছে মেকানিক্সের কনসার্ট ট্যুর। ইতিমধ্যে তারা পারফর্ম করেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও যশোরে। আরও কয়েকটি জেলায় শো করার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় একটি বড় কনসার্ট আয়োজনের পরিকল্পনা চলছে, যেখানে পুরোনো সদস্যদেরও দেখা যাবে মঞ্চে। ত্রিদিব বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সংগীত পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। মেকানিক্সকে আরও অনেক দূর নিয়ে যেতে চাই। যদি ওয়ারফেজের মতো ৪০ বছর ধরে টিকে থাকতে পারি, সেটাই হবে আমাদের সাফল্য। আসলে ব্যান্ডের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সেই বোঝাপড়া, যেখানে আমার মনের কথা না বললেও অন্যজন তা বুঝে নেয়। ২০ বছরের এই পথচলায় সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় জয়।’