সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক বাজার—সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা ছোট-বড়–মাঝারি হাস্যোজ্বল বাঘ। চমকে উঠলেন তো? চমকে উঠেছিলেন শহরে নতুন আসা আমার জর্জিয়ান বান্ধবী টিওনাও। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল ‘টাইগার’ আদতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব রটারডেমের লোগো। শহরবাসী ও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত অতিথিদের এই বাঘের মাধ্যমেই অভ্যর্থনা জানাচ্ছে নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রের জন্য বিশ্বখ্যাত এ উৎসব। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব রটারডেমের এবারের আয়োজনে প্রদর্শিত হবে ৭১টি দেশের ৪০০টির বেশি চলচ্চিত্র।
নরওয়ের চলচ্চিত্র ‘মাঞ্চ’ প্রদর্শনের মাধ্যমে রটারডেম উৎসবের পর্দা উঠল ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। সিনেমা শুরুর আগে মঞ্চে এলেন উৎসবের পরিচালক ভাঞ্জা ক্যালুদ্যেরসিক। ভাঞ্জার বক্তব্যের অনেকটা জুড়ে রইল মহামারির বিষণ্ন সময় পার করে, দুই বছর পর থিয়েটারে ফিরতে পারার আনন্দের কথা, ‘সিনেমা শুধু শিল্প বা বিনোদন নয়, সিনেমা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে ও বেঁচে থাকার গল্প বলে। মহামারি থেকে আমি এই শিক্ষাই পেয়েছি।’
এরপর সিনেমার অভিনেতাদের নিয়ে মঞ্চে এলেন উদ্বোধনী চলচ্চিত্র ‘মাঞ্চ’–এর পরিচালক হেনরিক এম দ্যালসবাকেন। সিনেমার বিষয়বস্তু নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী এডভার্ড মাঞ্চের বৈচিত্র্যময় জীবন। তবে নিজের বক্তব্যে হেনরিক বললেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা, ‘না, মাঞ্চের জীবনী নিয়ে আমি আমার সিনেমাটি বানাইনি। একজন মাঞ্চকে সেলুলয়েডে ধারণ করার প্রতিভা আমার বা আমাদের নেই বলেই আমি মনে করি। আমি শুধু একটি গল্প বলতে চেয়েছি, যে গল্পে শিল্প ও জীবন, জীবন ও শিল্পের সমান্তরাল যাতায়াত।’
১১ দিনব্যাপী এ চলচ্চিত্র উৎসবে হেনরিকের মতোই ‘গল্প বলার’ স্বপ্ন নিয়ে এসেছেন বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাষার পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতারা। রটারডেম শহরের প্রায় মধ্যখানে ‘ডি ড্যোলেন’ নামের এক বিশাল ভেন্যুতে দেখা মিলবে তাঁদের। তাঁরা নানা দেশের সিনেমা দেখছেন, কথা বলছেন নিজের সিনেমা ও অন্যের সিনেমা নিয়ে, জানাচ্ছেন নিজ দেশে সিনেমা নির্মাণ নিয়ে অভিজ্ঞতার কথাও।
‘হ্যাঁ, সময় এখন কঠিন। হয়তো সামনে সবকিছু আরও কঠিন হবে। তবু আমাদের গল্পটা তো আমাদেরই বলতে হবে’, বলছিলেন এক সাবেক তামিল টাইগারের পুনর্বাসিত জীবন নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মুন্নেল’–এর শ্রীলঙ্কান পরিচালক ভিসাকেসা চন্দ্রশেখরম। কথায় কথায় ভিসাকেসা আরও বললেন দক্ষিণ এশীয় সিনেমায় সেন্সরশিপ নিয়ে তাঁর হতাশার কথা, শোনালেন শ্রীলঙ্কার এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে সিনেমা নির্মাণ কী দুঃসাধ্য এক কাজ।
চন্দ্রশেখরমের পর গল্প বলার এমন সব খুঁটিনাটি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করেন মরোক্কান নির্মাতা লেইলা কিলানি, ভারতীয় পরিচালক চাভাদা ও আরও অনেকে। রাত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে গল্পও। ফিরতি পথে, মেট্রো স্টেশনে আমাদের আবারও দেখা হয় হাস্যমুখী এক বাঘের সঙ্গে, তার হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘দ্য টাইগার ইজ ব্যাক টু রোর!’