গ্রেগরি পেক: একজন ‘চূড়ান্ত চলচ্চিত্র তারকা’

১৯১৬ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হলিউডের কিংবদন্তি শিল্পী গ্রেগরি পেক। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার গ্রেগরি পেক তাঁর অসাধারণ কণ্ঠ ও বাক্‌ভঙ্গিমার কারণে জয় করে নিয়েছিলেন দর্শকমন। হলিউড এ পর্যন্ত যত শিল্পী উপহার দিয়েছে, তার মধ্যে গ্রেগরি পেকের নাম থাকবে শীর্ষ তালিকায়। জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন এ বি এম খায়রুল কবীর

নানা রূপে গ্রেগরি পেককোলাজ

যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেখানে ভালোবাসা দিবসে আমরা সহকর্মীরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাই। ঘরোয়া আয়োজনে একসঙ্গে বসে আইসক্রিম খাই। গত ফেব্রুয়ারিতে ভালোবাসা দিবসের আয়োজনের কোনো এক ফাঁকে সিনেমা নিয়ে কথা হয়, আমাদের সম্পাদকের কাছে জানতে চাই তাঁর পছন্দের সিনেমার কথা। তিনি স্মৃতি ঝাঁপি খুলে দেন, ১৯৫৬ সালে ঢাকার গুলিস্তানের একটি সিনেমা হলে তাঁর বড় দুই ভাইসহ ‘রোমান হলিডে’ সিনেমাটি দেখেছিলেন। আজও তার মনে গেঁথে আছে গ্রেগরি প্যাক ও অড্রে হেপবার্নের অভিনয়। বিষয়টি আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। আমার মাথায় ঘুরতে থাকে, কে এই গ্রেগরি প্যাক!
গুগল তথ্য দেয়, ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পুরো বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতার নাম এলড্রেড গ্রেগরি পেক! ১৯১৬ সালের ৫ এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করা গ্রেগরি পেক অভিষেকের পর থেকে পাঁচ দশক ধরে হলিউডের সেরা অভিনেতার একজন ছিলেন। সাদাসিধে মার্কিন চেহারার জন্য ‘বেভারলি হিলসের লিংকন’ বলেও ডাকা হতো তাঁকে।

তাঁর বাবা গ্রেগরি পার্ল পেক ছিলেন রসায়নবিদ ও ফার্মাসিস্ট; মা বার্নিস মে পেশায় ছিলেন টেলিফোন অপারেটর। পাঁচ বছর বয়সে মা–বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে পরে পেক তাঁর মাতামহী ক্যাথরিন অ্যাশের আশ্রয়েই বড় হতে থাকেন। ছোটবেলায় তাঁর মাতামহী ক্যাথরিন অ্যাশ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাঁকে নিয়ে নির্বাক সিনেমা দেখতে যেতেন। সেখান থেকেই তাঁর সিনেমাপ্রীতির শুরু। কিন্তু স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। মাতামহী মারা যান, চৌদ্দ বছরের পেক ফেরেন বাবার কাছে, হাইস্কুল শেষ করেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন, ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে। এ সময় এতটাই অর্থাভাবে পড়েন, ঠিকমতো খাবার খেতে পারতেন না। শুধু খাবারের বিনিময়ে, একটি খাবার হোটেলের রান্নাঘরের সহকারীর কাজ করেন কিছুদিন।

১৯৪০ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পুরো বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতার নাম এলড্রেড গ্রেগরি পেক! ১৯১৬ সালের ৫ এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করা গ্রেগরি পেক অভিষেকের পর থেকে পাঁচ দশক ধরে হলিউডের সেরা অভিনেতার একজন ছিলেন।
গ্রেগরি পেক
আইএমডিবি

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে পাবলিক স্পিকিং কোর্স করতে গিয়ে অভিনয় কোচের অনুপ্রেরণায় অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করেই গ্রেগরি পেক ১৯৩৯ সালে পকেটে ১৬০ ডলার নিয়ে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, সুদর্শন পেক তাঁর নিজের ওপর বাজি ধরেছিলেন। নিউইয়র্কে পৌঁছে অভিনয়ের পাঠ নেন ‘নেভারহুড প্লে–হাউস’–এ। এ সময়টাতে তিনি আবারও অর্থকষ্টে পড়েন এবং কখনো নিলামকারী, আবার কখনো ট্যুর গাইডের কাজ করেন।

ওয়েস্টার্ন ও অ্যাডভেঞ্চার সিনেমাগুলোয় তাঁর অভিনয়শৈলীর কারণে চলচ্চিত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। গ্রেগরি পেক হলিউড সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন তারকা—দশকের পর দশক ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর সিনেমাগুলো এখনো উপভোগ করে। পেক অভিনয় করতেন দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে। হলিউডের সবচেয়ে সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান নায়ক ছিলেন। অসাধারণ কণ্ঠ ও বাক্‌ভঙ্গিমার কারণে জয় করে নিয়েছিলেন দর্শকমন; অস্কার জেতার আগে থেকেই তিনি সবার প্রিয় হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। প্রথম চারবার অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েও অস্কার পাননি, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে পঞ্চমবারে। সাধারণত পর্দার অভিনেতাকে তাঁর বাস্তব জীবনের সঙ্গে মেলানো বড় কঠিন। কিন্তু গ্রেগরি পেকের বাস্তব জীবন এবং অভিনয়জীবন ছিল অনেকটা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো।

পেক অভিনয় করতেন দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে। হলিউডের সবচেয়ে সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান নায়ক ছিলেন। অসাধারণ কণ্ঠ ও বাক্‌ভঙ্গিমার কারণে জয় করে নিয়েছিলেন দর্শকমন; অস্কার জেতার আগে থেকেই তিনি সবার প্রিয় হিসেবে সম্মানিত ছিলেন।
গ্রেগরি পেক (৫ এপ্রিল ১৯১৬–১২ জুন ২০০৩)
ফেসবুক পেজ

‘দ্য কিজ অব দ্য কিংডম’ (১৯৪৪), ‘দ্য ইয়ার্লিং’ (১৯৪৬), ‘জেন্টলম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ (১৯৪৭) ও ‘টুয়েলভ ওক্লক হাই’ (১৯৪৯) চলচ্চিত্রের জন্য মোট চারবার একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।
‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ ছবিতে ধর্মান্ধতা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া ‘অ্যাটিকাস ফিঞ্চ’ নামে আইনজীবী চরিত্রের জন্য পান অস্কার পুরস্কার (১৯৬২)। দুর্দান্ত অভিনয়ের ফলে শুধু একটি চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ‘অ্যাটিকাস ফিঞ্চ’ হয়ে ওঠে সমসাময়িক মানুষের জাতিগত কুসংস্কার ও আত্মার নৈতিক পচনের মোকাবিলা করার লড়াইয়ের প্রতীক! ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ সর্বকালের সেরা একটি কোর্টরুম সিনেমা বলে স্বীকৃত। এ ছবিটিকে নিজের পছন্দতালিকার শীর্ষস্থানে রেখেছিলেন।

পেকের মৃত্যুর পর এই উপন্যাসের রচয়িতা হার্পার লি মন্তব্য করেছিলেন, ‘গ্রেগরি পেক একজন সুন্দর মানুষ ছিলেন। “অ্যাটিকাস ফিঞ্চ” চরিত্রটি তাঁর নিজেকে নিয়ে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল। পেক ছিলেন খুবই নিবেদিতপ্রাণ একজন অভিনেতা। “টু কিল আ মকিং বার্ড” সিনেমার কোর্টরুমের ডায়ালগ দেওয়ার জন্য তিনি ৫০০ বারের বেশি রিহার্সাল করেন, যেন তিন যা চান তা সঠিকভাবে করতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভালো প্রস্তুতিই কেবল দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের দিকে পরিচালিত করে। তিনি তাঁর কাজে নৈপুণ্য এবং কৌশলের সঙ্গে নিরলস মুগ্ধতা যোগ করতে পেরেছিলেন!’

‘রোমান হলিডে’ ছবিতে গ্রেগরি পেক ও অড্রে হেপবার্ন
আইএমডিবি

অড্রে হেপবার্নের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘রোমান হলিডে’ (১৯৫৩) করেন। ইউরোপীয়ান এক রাজকন্যার সঙ্গে একজন মার্কিন সাংবাদিকের রসায়নের গল্পটি বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফলতা পায়। ‘রোমান হলিডে’র মাধ্যমে এই জুটি স্থান করে নেয় বিশ্বব্যাপী কোটি ভক্তের হৃদয়ে। অড্রে হেপবার্ন এই সিনেমার জন্য অস্কার জেতেন।
‘টুয়েলভ ও’ক্লক হাই’ (১৯৪৯) সিনেমায় অভিনয় করেছেন জেনারেল ফ্রাঙ্ক স্যাভেজের চরিত্রে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসাধারণ এক সত্য গল্পের কাল্পনিক রূপ। ‘দ্য গানফাইটার’ (১৯৫০) সিনেমায় বন্দুকবাজ জিমি রিংগোর ভূমিকায় অভিনয় করেন। খুব সাধারণ একটি গল্প শুধু পেকের উপস্থিতি ও দুর্দান্ত অভিনয়ের মাধ্যমে অসাধারণ হয়ে ওঠে।

গ্রেগরি পেক সব সময় যে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, এমনটা নয়। ‘দ্য বয়েজ ফ্রম ব্রাজিল’ (১৯৭৮) সিনেমায় পেক ডক্টর জোসফ মেঙ্গেল নামের মানব ইতিহাসের অন্যতম এক দুষ্ট পুরুষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
তাঁর অভিনীত অন্যান্য সফল চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘স্পেলবাউন্ড’ (১৯৪৫), ‘মবি ডিক’ (১৯৫৬), ‘দ্য বিগ কান্ট্রি’ (১৯৫৮), ‘দ্য ব্রেভাডস’ (১৯৫৮), ‘পর্ক চপ হিল’ (১৯৫৯), ‘দ্য গানস অব নাভারোন’ (১৯৬১), ‘কেপ ফেয়ার’ (১৯৬২, ও এর ১৯৯১-এর পুনর্নির্মাণ), ‘দ্য ওমেন’ (১৯৭৬) ও ‘ম্যাকেনা’স গোল্ড’ (১৯৬৯) অন্যতম। আমাদের দেশের দর্শকদের বেশির ভাগই তাঁর ‘গানস অব নাভারন’, ‘স্পেলবাউন্ড’, ‘মবিডিক’ ছবিগুলোর কথা মনে রাখবে। আর অবশ্যই বিশেষভাবে মনে রাখবে ‘রোমান হলিডে’ ছবির কথা।

গ্রেগরি পেক শুধু একজন সফল অভিনেতাই নন, ছিলেন রাজনৈতিকভাবে প্রগতিশীল, যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের সক্রিয় কর্মী। নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন লড়াই করে গেছেন।
গ্রেগরি পেক
ইনস্টাগ্রাম

গ্রেগরি পেক শুধু একজন সফল অভিনেতাই নন, ছিলেন রাজনৈতিকভাবে প্রগতিশীল, যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের সক্রিয় কর্মী। নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন লড়াই করে গেছেন। বিশ্বসম্প্রদায়কে জীবনের প্রতি অনুপ্রেরণার জন্য গ্রেগরি পেক তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
তাঁর ছেলে অ্যান্টনি পেক বাবা সম্পর্কে বলেন, ‘গ্রেগরি পেক শেষ অবধি নিজের প্রতি সৎ ছিলেন। মানুষের প্রতি সৎ ছিলেন। দেশের প্রতি সৎ ছিলেন। তাঁকে কখনোই কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করা যায়নি। তিনি একজন ভালো বাবা, একজন ভালো স্বামী এবং একজন ভালো নাগরিক ছিলেন।’

বাণিজ্যিক জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায়ও তিনি ছিলেন একজন ধ্রুপদি ব্যক্তিত্ব, জ্ঞানী এবং সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য। তাঁর মধ্যে কোনো কপটতা কাজ করত না। পর্দায় যেমন বাড়িতে এবং বন্ধ দরজার পেছনেও তিনি একই রকম মানুষ ছিলেন। পেক সঠিক কাজ করার ক্ষেত্রে পরিণতি নিয়ে কখনোই কোনো উদ্বেগ বোধ করতেন না, যা পক্ষান্তরে খুবই বিরল। গ্রেগরি পেকের বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীরা বুদ্ধিমান, মানবিক, সৎ এবং সাহসী—এই শব্দগুলো ব্যবহার করত। ১২ জুন ২০০৩ সালে গুণী এই অভিনেতা তাঁর জন্মস্থান ক্যালিফোর্নিয়াতেই মারা যান।

ছাত্র জীবনে গ্রেগরি পেক
উইকিমিডিয়া

পর্দার মতোই বাস্তব জীবনেও তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের নায়ক। দুর্দশায় থাকা সহকর্মীদের ছিলেন অনুগত বন্ধু, অভিভাবকের মতো পাশে দাঁড়াতেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন পেককে তাঁর আজীবন মানবহিতৈষী কর্মের জন্য ১৯৬৯ সালে ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’–এ ভূষিত করেন। পেক শুধু একজন তারকা অভিনেতাই ছিলেন না, অনেক দাতব্য, রাজনৈতিক এবং চলচ্চিত্র উন্নয়নের কাজে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্টসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির চেয়ারম্যান, আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৯ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আজীবন সম্মাননা পান।
আজ ৫ এপ্রিল এই মহানায়কের জন্মদিন। শ্রদ্ধাভরে তাঁর কথা স্মরণ করে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মতো করে বলতে চাই, গ্রেগরি পেক, আপনি একজন ‘চূড়ান্ত চলচ্চিত্র তারকা’।

রোমান হলিডে ছবিতে অড্রে হেপবার্ন ও গ্রেগরি পেক
আরও পড়ুন