কানেও নারী নির্মাতার জয়গান

মঞ্চে ৭৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিভিন্ন বিভাগের পুরস্কার বিজয়ীরাছবি: রয়টার্স
মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে রেকর্ড সাত নারী নির্মাতার সিনেমা। স্বর্ণপাম যেকোনো নারী নির্মাতার হাতেই উঠতে যাচ্ছে, অনেক সমালোচকই তা পূর্বানুমান করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত  হলোও তা-ই। কেন লোচ, মার্কো বেলুচ্চিও, নানি মোরেত্তি, আকি কাউরিসমাকি, নুরি বিলগে জেলান, টড হেইনস, হিরোকাজু কোরে-এডা, ওয়েস অ্যান্ডারসনের মতো হেভিওয়েট পরিচালককে পেছনে ফেলে স্বর্ণপাম জিতল ফরাসি নির্মাতা জাস্টিন ত্রিয়েতের ছবি। পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে গত শনিবার রাতে ১২ দিন ধরে চলা কান উৎসবের পর্দা নেমেছে। এএফপি, বিবিসি, আইএমডিবি অবলম্বনে এবারের গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারগুলো নিয়ে এই প্রতিবেদন।

স্বর্ণপাম
‘অ্যানাটমি অব আ ফল’, ফ্রান্স
মার্ডার মিস্ট্রি, কোর্টরুম ড্রামা ঘরানার ছবিটি দিয়েই স্বর্ণপাম জিতেছেন ৪৪ বছর বয়সী ফরাসি নির্মাতা জাস্টিন ত্রিয়েত। এ নিয়ে তৃতীয়বার কানে স্বর্ণপাম জিতল কোনো নারী নির্মাতার ছবি।

স্বর্ণপাম হাতে ফরাসি নির্মাতা জাস্টিন ত্রিয়েত। ছবি: রয়টার্স

তথ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়ে হাত পাকানো ত্রিয়েত ২০১৩ সালে তৈরি করেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা, এজ অব প্যানিক। আর চতুর্থ ছবিতেই মিলল স্বর্ণপাম। পুরস্কার গ্রহণের পর ত্রিয়েত বলেন, ‘তৃতীয় নারী হিসেবে পুরস্কার নেওয়াটা আনন্দের ব্যাপার, পরিবর্তন ভালোর দিকে হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

‘অ্যানাটমি অব আ ফল’ স্বামীকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত এক লেখিকার গল্প। স্বামী খুনের দায়ে অভিযুক্ত স্ত্রী, খুনের একমাত্র সাক্ষী তাঁদের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সন্তান—সব মিলিয়ে পর্দায় মানসিক দ্বন্দ্বটা যেভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক, জুরিদের সেটা ভাবিয়েছে। ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন জান্দ্রা হলা। এই জার্মান অভিনেত্রীর এবারের কান উৎসব নিশ্চিতভাবেই আজীবন মনে থাকবে। কারণ, স্বর্ণপামজয়ী ছবিটা ছাড়াও গ্রাঁ প্রিজয়ী সিনেমাটাতেও যে অভিনয় করেছেন তিনি।

‘অ্যানাটমি অব আ ফল’ সিনেমার পোস্টার
আইএমডিবি

‘চলতি বছরের প্রতিযোগিতা বিভাগের সিনেমাগুলো বেশ শক্তিশালী ছিল, সিনেমাগুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে,’ উৎসব নিয়ে বলেন প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান জুরি রুবেন ওস্টল্যান্ড। গত বছর এ নির্মাতাই ‘ট্রায়াঙ্গেল অব স্যাডনেস’-এর জন্য স্বর্ণপাম জিতেছিলেন।

গ্রাঁ প্রি
‘দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট’, যুক্তরাজ্য
অশউইৎজ বন্দিশিবিরের পাশে এক পরিবারের বাস। পরিবারের কর্তা এক নাৎসি অফিসার। এই পরিবারের গল্প নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলেন ব্রিটিশ লেখক মার্টিন এমিস। সেই উপন্যাস থেকে একই নামের সিনেমা বানিয়েছেন জনাথন গ্লেজার।

গ্রাঁ পি হাতে যুক্তরাজ্যের নির্মাতা জনাথন গ্লেজার। ছবি: রয়টার্স

ছবিটি দিয়ে এক নাৎসি পরিবারের জীবনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। ছবিতে অশউইৎজ ক্যাম্পের ভয়াবহতা সরাসরি দেখাননি পরিচালক, শব্দ আর নিজের মুনশিয়ানা দিয়ে তুলে ধরেছেন নৃশংসতা। জান্দ্রা হলা নাৎসি অফিসারের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

আরও পড়ুন

চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে মিউজিক ভিডিও, সিনেমা ও টিভি সিরিজের ট্রেলার তৈরি করেছেন গ্লেজার। তবে তাঁর দুই দশকের ক্যারিয়ারে অন্যতম বড় অর্জন নিঃসন্দেহে কানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার জেতা।

সেরা পরিচালক
‘ট্রান আন হাং’, ফ্রান্স
জন্ম ভিয়েতনামে, ১২ বছর বয়সে চলে আসেন ফ্রান্সে। ১৯৯৩ সালে নিজের প্রথম ছবিতেই জানান দিয়েছিলেন প্রতিভার স্বাক্ষর, ‘দ্য সেন্ট অব গ্রিন পাপাইয়া’ সে বছর কানে ক্যামেরা দ’র জিতেছিল। তিন দশক পর নিজের সপ্তম ছবি দ্য পত-অঁ-ফু দিয়ে জিতলেন সেরা পরিচালকের পুরস্কার।

তিন দশক আগে ক্যামেরা দ’র দিয়ে শুরু হয়েছিল যাত্রা। এবার কানে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতলেন ট্রান আন হাং। ছবি: রয়টার্স

নির্মাতার কাজে বার্গম্যান, কুরোসাওয়া, ওজুসহ অনেক পরিচালকেরই প্রভাব লক্ষণীয়। তবে নিজের নির্মাণ নিয়ে আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক জানিয়েছিলেন, ছবি দিয়ে দর্শকের অনুভূতিকে চ্যালেঞ্জ করতে চান তিনি। সেরা পরিচালকের পুরস্কার পাওয়া নতুন ছবিটি ঐতিহাসিক রোমান্টিক ড্রামা।

১৮৮৫ সালের পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত ছবিতে আছেন জুলিয়েত বিনোশ ও বেনুয়া ম্যাজিমেল। পত-অঁ-ফু সবজি ও মাংস দিয়ে তৈরি ফ্রান্সের জনপ্রিয় খাবার, যা অল্প আঁচে রান্না করতে হয়। ছবিটি আসলে এক পাচকের প্রেমের গল্প। অল্প আঁচে রান্নার মতো ছবিতে দেখানো হয়েছে ধীরলয়ের প্রেম। ছবিতে রান্নার দৃশ্যই আছে প্রায় ৪০ মিনিট। পুরস্কার গ্রহণ করে পরিচালক তাঁর সব কৃতজ্ঞতা জানান জুলিয়েত বিনোশের প্রতি। পরিচালকের ভাষ্য, ছবিতে তিনি ছিলেন অসাধারণ।

সেরা অভিনেত্রী
মারভে দিজদার, ‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস’, তুরস্ক
তুরস্কের মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়ে মারভে দিজদার। শৈশবে বন্ধুরা যখন কেউ চিকিৎসক, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন ভিন্ন এক পথে হাঁটলেন দিজদার, হতে চাইলেন আদর্শবাদী অভিনেত্রী। পরিবার এতে সায় না দিলেও পাশে থেকেছে। শুরু করলেন অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা।

প্রথমবার কানে তুরস্কের কেউ জিতল সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার, মারভে দিজদার তাই একটু বেশিই উচ্ছ্বসিত। ছবি: রয়টার্স

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত হন। করেন টেলিভিশন সিরিয়ালও। কিন্তু অভিনয়ে তেমন অগ্রগতি হচ্ছিল না। পরিবারের কাছ থেকে দিজদারকে শুনতে হয়েছে, আর কত? নিজের খরচ জোগাতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেছেন। তারপরও থামেনি স্বপ্নের পেছনে ছোটা। সেই অভিনেত্রীই চমকে দিলেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে। তাঁর হাত ধরেই কানে প্রথমবার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার গেল তুরস্কে। পুরস্কারটি সংগ্রামী নারীদের উৎসর্গ করে তিনি বলেন, ‘আমার যে বোনেরা সংগ্রাম করে শক্তি জোগান, জীবনে ঝুঁকি নেন, কঠিন বাধা এলেও হাল ছেড়ে দেন না, যাঁরা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে যান শুধু ভালো দিনের জন্য; তুরস্কের আমার সেসব বোনদের এটা পাওনা।’ সেরা অভিনেত্রী পুরস্কারটি তাঁকে এনে দিয়েছে নুরি বিলগে জিলানের ‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস’ সিনেমা। এই ছবিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক আর্ট শিক্ষিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দিজদার।

সেরা অভিনেতা
কোজি ইয়াকুশো, ‘পারফেক্ট ডেজ’, জাপান
অভিনেতা হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। বাউন্ডুলে জীবনযাপন করতেন। ১৯৭৬ সালের দিকে রাস্তায় একদিন একটা নাটকের পোস্টার দেখতে পান এই তরুণ। নাম ‘দ্য লোয়ার ডেপথস’। রচয়িতা ম্যাক্সিম গোর্কি। নাটকটি দেখেন। নাটকের পাত্রপাত্রীদের অভিনয় দেখে অভিনয়ে অনুপ্রাণিত হন। দুই বছর মঞ্চ অভিনয়ের পর জানতে পারেন টেলিভিশনে অভিনয়ের সুযোগ আছে। চারজন সুযোগ পাবেন। অডিশনে গিয়ে দেখেন ৮০০ জন আবেদন করেছেন। সেদিনই ভেবেছিলেন, চারজন নয় একজন নিলেও তিনি জায়গা করে নেবেন। সেই মনোবলই তাঁকে চারজনের মধ্যে জায়গা করে দেয়। চার দশকের ক্যারিয়ারে তিনি হয়ে ওঠেন জাপানের কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পীদের একজন।

সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিয়ে উচ্ছ্বসিত কোজি ইয়াকুশো। ছবি: রয়টার্স

অভিনয়ে অনেক স্বীকৃতি পেলেও এবারই প্রথম কান উৎসবের সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেলেন। পুরস্কার নিয়ে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এবারই প্রথম খুব স্বল্প সময়ে কোনো রিহার্সেল ছাড়া অভিনয় করেছি। চরিত্রটি আমাকে পুরস্কৃত করল। কৃতজ্ঞতা ভিম (ভেন্ডার্স)।’
কোজি পুরস্কার পেয়েছেন ‘পারফেক্ট ডেজ’ সিনেমায় অভিনয় করে। টয়লেট ক্লিনারের মানবিক গল্প নিয়ে ছবি। যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন কোজি।

ক্যামেরা দ’র
থিয়েন আন ফাম, ‘ইনসাইড দ্য ইয়েলো কোকুন শেল’, ভিয়েতনাম
এবারের কান যেন ভিয়েতনামের জয়জয়কার। সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন ভিয়েতনামিজ-ফরাসি নির্মাতা ট্রান আন হাং।

থিয়েন আন ফাম
রয়টার্স

অন্যদিকে প্রথম ছবির জন্য দেওয়া পুরস্কার ক্যামেরা দ’র-এ সেরা হয়েছেন ভিয়েতনামেরই আরেক নির্মাতা থিয়েন আন ফাম। নিজের শহরে ফেরা এক ব্যক্তির গল্প নিয়ে তাঁর প্রথম সিনেমা। অতীত স্মৃতি আর কামনা যাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। কানে প্রিমিয়ারের পর ভ্যারাইটি, ডেডলাইন প্রভৃতি পত্রিকার সমালোচকের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন নির্মাতা।