আপনার বয়স ৫০ বছর, আজ ৯০ হলো কীভাবে...
জেলে বন্দী হয়েও তিনি সিনেমার কাজ করেন। গৃহবন্দী থেকেও বানিয়ে ফেলেন আন্তর্জাতিক মানের সব সিনেমা, যা চমকে দেয় সিনেমাপ্রেমী বিশ্ববাসীকে। তাঁর কাছে করোনা যে কোনো বাধা হবে না, সেটা অনুমেয়ই ছিল। যখন দেশে দেশে চলছে লকডাউন। বাইরে বের হওয়ার অবস্থা নেই, একের পর লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে করোনায়। সেই সময় ঘরে বসেই বানিয়ে ফেলেন ডকুশর্ট ফিল্ম। ‘লাইফ’ নামের সেই সিনেমা ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে। কী আছে এই তথ্যচিত্রে?
জাফর পানাহির সিনেমা মানেই দৃশ্যমান সীমাবদ্ধতার ভেতর লুকিয়ে থাকা অসীম সত্যের প্রকাশ। রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা, চলাচলের প্রতিবন্ধকতা কিংবা ব্যক্তিগত বন্দিত্ব—সবকিছুর মধ্যেও তিনি ব্যতিক্রমভাবে ধরা দেন। ‘ট্যাক্সি’, ‘হিডেন’ ও ‘নো বেয়ারস’—এমনকি সর্বশেষ কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণপামজয়ী সিনেমা ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ সিনেমাটিও সেই কথাই বলে। তবে এবার ভিন্নভাবে দর্শকদের সামনে আসলেন জীবনবোধ, বাস্তবতা ভরা অনন্য এক কাব্যিক গল্প নিয়ে। সেই তথ্যচিত্রের গল্প তাঁর পরিবারের মানুষেরা। যে পরিবারকে বন্দী রেখেছে করোনা। উল্লেখ্য, সেই সময় ইরানে ১৪ বছরের গৃহবন্দী হয়ে জীবন যাপন করছিলেন এই পরিচালক। সেই সময় ভবনধসের মৃত্যুর ঘটনায় দেশের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় পানাহির মতো মোহম্মদ রসুলুফেরাও ছিলেন কড়া রাষ্ট্রীয় বেড়াজালে। সেসব চিত্রই কি ফিরে আসে ‘লাইফ’—এ? সে প্রশ্নও ছিল সমালোচকদের।
‘লাইফ’-এ পানাহি কোনো বড় ঘটনা বলেন না। তিনি দেখান দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা। এর মাঝে জীবন ধরা দেয় নীরবতা আর স্থিরতার গল্প হয়ে। কিন্তু কখনো কখনো এই স্থিরতার ভেতরেই তৈরি হয় অস্বস্তি। কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে মানুষের জীবন যেন এক অদৃশ্য ঘেরাটোপে বন্দী। ক্যামেরা সেই বন্দিত্বকে পর্যবেক্ষণ করে দূরত্ব রেখে, যেন দর্শক নিজেই নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হয়। আদতে করোনা নাকি বন্দী জীবনের গল্প বলেছেন এই পরিচালক?
কী আছে ‘লাইফ’-এ
পানাহির স্ত্রী হঠাৎই ভীত হয়ে যান। কেউ একজন বেশ কিছু সময় ধরে কলিং বেলে চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু সেই ব্যক্তিকে জানালা দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ তিনিই দরজায় কড়া নাড়লে চিনতে পারেন তাঁর শাশুড়ি। পানাহি নিজেই সব ভিডিও করেন। তাঁর মাকে ঘিরেই এগিয়ে চলে গল্প। তাঁর মা করোনার মুহূর্তগুলোতে মৃত্যুর অপেক্ষা করে। তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় তিনি সবাইকে সমান ভাগে ভাগ করে দেন। যেন মৃত্যুর পর এগুলো নিয়ে কেউ কথা বলতে না পারে। করোনার এই দূরত্বের; ১৯ মিনিটের গল্পের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ, মাতৃস্নেহের কথা, উঠে আসে ভীত এক বন্দী জীবনের কথা। এর মধ্যে দিয়ে ইরানি সমাজ বাস্তবতার চিত্র ফুটে ওঠে, যা সময়ের ভেতরকার মানসিক ও অস্তিত্বগত সংকটকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।
ব্যতিক্রম নির্মাণশৈলী
সব সময়ই নির্মাণ কৌশলের পাশাপাশি পানাহির সিনেমায় আলাদা গুরুত্ব থাকে শক্ত বার্তা ঘিরে। দেশে বন্দী অবস্থায় নিজেই ট্যাক্সি চালিয়ে ইরানের মানুষের মতামত নেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে উঠে আসে নানা কথা। সেই গল্পই পরে ‘ট্যাক্সি’ সিনেমা হিসেবে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সিনেমার পুরস্কার পায়। আলোচনায় আসে। এবারও নেই আহামরি নির্মাণ কৌশল, নেই আবেগ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বাস্তবতা নিজেই কথা বলে। পানাহির এই নির্মাণভঙ্গি নতুন কিছু নয়, বরং তাঁর দীর্ঘদিনের চলচ্চিত্র ভাষারই ধারাবাহিকতা। ‘লাইফ’ তিনি মুঠোফোন দিয়ে নির্মাণ করেছেন। জাফর পানাহি নিজেই ক্যামেরা চালিয়েছেন। কখনো তাঁকে সহায়তা করেছেন তাঁর স্ত্রী।
যা বাড়তি ভালো লাগে
ইগুয়ানা (আমেরিকার খুব বড় আকারের গেছো গিরগিটি) দেখতে অনেকটাই গুইসাপের মতো। তবে এর আকৃতি বেশ বড়। এটা পরিচালকের পোষা প্রাণী। প্রাণীটি বাড়িতে অন্যদের মতো চলাফেরা করে। এটি সবার কথাই শোনে। একমাত্র পানাহির মা এই প্রাণীকে ভয় পান। কিন্তু একসময় তাঁর মায়ের সঙ্গেও প্রাণীটির বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যা মনে করিয়ে দেয় মানুষের একাকিত্বের কথা। ছাড়া তাঁর মায়ের সঙ্গে মেয়ের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে ইরানি সমাজের পারিবারিক বন্ধনের চিত্র উঠে আসে। দাদি ও নাতির আলাপ বেশ ভালো লাগে। প্রথম দিন যখন তাঁর দাদি পুরো শরীরে সাদা কাপড় জড়িয়ে বাসায় আসে সেই নিয়ে নাতি মজা করে বলে, ‘দাদি তুমি এত সাদা কাপড় পরেছিলা কেন, আবার কি বিয়ে করতে চাও।’ এই নিয়ে হাসাহাসি।
নাতি বিদেশে থাকে। সে কোন সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে, সেগুলো ধরা দেয়। মাঝেই আবার দাদির অভিমান। এর মাঝেই পানাহির মা একসময় বলেন, ‘আর কত দিন বাঁচব। ৯০ বছর তো বয়স হয়েই গেল।’ এই নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে বউয়ের মজার খুনসুটি। পানাহির স্ত্রী তাঁর শাশুড়িতে বলেন, ‘আম্মা সেদিনও বললেন, আপনার বয়স ৫০ বছর, আজ ৯০ হলো কীভাবে?’ শাশুড়ির মধ্যে মৃত্যু নিয়ে ভীতি না জোগাতে এমন সংলাপ বাড়তি ভালো লাগা তৈরি করে। সব মিলিয়ে উপভোগ্য হয়ে ওঠে এই ১৯ মিনিটের ডকুড্রামা।
কীভাবে দেখবেন সিনেমাটি
কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সিনেমার পুরস্কারের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’। এটি চারটি শাখায় গোল্ডেন গ্লোবে মনোনয়ন পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, অস্কার আয়োজনেও এটি বাজিমাত করতে পারে। এর মধ্যেই ১২ ডিসেম্বর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘নিয়ন’ ডকুড্রামাটি তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করেছে।
সবশেষে বলা যায়, মহামারি নিয়ে তৈরি অনেক কাজই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে। কিন্তু ‘লাইফ’ সেই ঝুঁকি এড়িয়ে যায়। কারণ, এটি ভাইরাসের গল্প নয়; এটি মানুষের অস্তিত্বের গল্প। ভবিষ্যতে হয়তো করোনা কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে, কিন্তু এই ছবির প্রশ্নগুলো—একাকিত্ব, অনিশ্চয়তা, টিকে থাকার অর্থ সব সময়ই প্রাসঙ্গিক রয়ে যাবে।