অভিনয় ছেড়ে কাঠমিস্ত্রি হতে চাওয়া সেই মেয়েটিই এখন অস্কার-দৌড়ে
একসময় অভিনয় ছেড়ে কাঠমিস্ত্রি হওয়ার কথা ভেবেছিলেন তিনি। সেই অভিনেত্রীই এখন কিনা অস্কার-দৌড়ে। হচ্ছিল রেনাতে রেইন্সভের কথা। ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রশংসায় ভাসছেন নরওয়ের এই অভিনেত্রী।
রিভিউ পড়ে বমি
২০২১ সালের জুলাইয়ের একদিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে রেনাতে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বমি করলেন। নরওয়ের এই অভিনেত্রী তখন কানে ছিলেন; আগের রাতে সেখানে প্রিমিয়ার হয়েছে ‘দ্য ওয়ার্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ সিনেমার।
ইয়েকিম ত্রিয়ার পরিচালিত ছবিটিতে জুলির চরিত্রে এক তরুণীর খামখেয়ালি অথচ আপসহীন যাত্রা দেখানো হয়; সেটিই ছিল প্রধান চরিত্রে রেনাতে প্রথম সিনেমা। প্রদর্শনী চলাকালেই তাঁর মনে হয়েছিল, ‘এই ছবিটা দারুণ; কিন্তু আমি ভীষণ বাজে!’ কয়েক ঘণ্টা পরই গার্ডিয়ানে সিনেমার রিভিউয়ে তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়—সম্ভবত রেনাতে তাঁর প্রজন্মের সেরা অভিনেত্রীদের একজন। ‘এতটাই অতিরিক্ত মনে হয়েছিল যে মানতে পারিনি, তাই বমি করতে শুরু করলাম। তবে খুশিও হয়েছিলাম বৈকি। নিজের সম্পর্কে সব ধারণাই মুহূর্তে বদলে গেল’, বলেন তিনি।
এরপর কানে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন রেনাতে রেইন্সভে। তাঁর অভিনয় পরে বাফটাসহ নানা পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আসে (ছবিটি নিজেও পায় দুটি অস্কার মনোনয়ন)। এই স্বীকৃতিগুলো আত্মবিশ্বাস বাড়ালেও ৩৮ বছর বয়সী রেনাতে জানতেন—প্রশংসা মাথায় তোলা যাবে না। ‘আমি খুব অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর ভাবলাম, ঠিক আছে, এটা থেকে একটু দূরত্ব রাখতে হবে। সমালোচনাকে যেমন অতিরিক্ত নেওয়া যায় না, তেমনি প্রশংসাকেও নয়’, বলেন তিনি। এমন স্বীকৃতি নিশ্চয়ই নেশার মতো লাগে? প্রশ্নের উত্তরে রেনাতে বলেন, ‘জীবনে সবই ক্ষণস্থায়ী। তাই লক্ষ্য ছিল—সবকিছু একটু সমান রাখব, নিজের যে ছবি নিজের মনে আছে সেটাকে অক্ষুণ্ন রাখব।’
খ্যাতি থেকে দূরে
রেনাতে রেইন্সভে যতটা সম্ভব তারকাখ্যাতির প্রচলিত রূপ থেকে দূরে থাকেন। ‘দ্য ওয়ার্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্রে যে দ্রুতই ডাক পাবেন, সেটি অনুমিতই ছিল। সেটি হয়ও। রেনাত অভিনয় করেন সেবাস্তিয়ান স্ট্যানের বিপরীতে ‘আ ডিফারেন্ট ম্যান’-এ।
চলতি বছরের মে মাসে ত্রিয়ার ও রেনেতে নির্মাতা-অভিনেত্রী জুটি আবার কানে ফেরেন ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’ নিয়ে; পরিবার, শিল্প ও ভালোবাসার টানাপোড়েন নিয়ে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছবি। এখানে তিনি নোরা, এক বিষণ্ন অভিনেত্রী—যার বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্রকার বাবা (স্টেলান স্কারসগার্ড) হঠাৎ জীবনে ফিরে এসে তাঁর জন্য লেখা আধা আত্মজীবনী চিত্রনাট্য সামনে ধরেন। ক্ষুব্ধ নোরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে বাবা সেই চরিত্রে নেন উঠতি আমেরিকান তারকা র্যাচেলকে (এল ফ্যানিং), আর নিজের বিচিত্র উপস্থিতিতে নোরা ও তার বোন আগনেসকে অস্বস্তিতে রাখতেই থাকেন।
ছবিটির শুটিং চলাকালেই রেনাতে নিজেকে বোঝান—এই ছবি কখনোই ‘দ্য ওয়ার্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর সমকক্ষ হবে না। কানে উৎসবে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, “সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু” ততটা তাৎক্ষণিকভাবে মনকাড়া নয়। তবে এটি সুন্দর, বিধ্বংসী, থিমে সমৃদ্ধ এক প্রজন্মান্তরের শক্তিশালী কাজ।’ পরে ছবিটি গ্রাঁ প্রি জেতে, এখন তো ছবিটি অস্কার দৌড়ে আছে। পেয়েছে গোল্ডেন গ্লোবে মনোনয়নও। কানে ছবিটি পেয়েছে ১৯ মিনিটের স্ট্যান্ডিং ওবেশন—উৎসবে ইতিহাসে তৃতীয় দীর্ঘতম।
জুলি ও নোরা
‘দ্য ওয়ার্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর জুলি ও ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’র নোরা—দুটি চরিত্রই নির্মাতা ত্রিয়ের রেনেতের কথা ভেবেই লিখেছেন। তাহলে কি চরিত্রগুলো আসলে তাঁরই প্রতিচ্ছবি? জুলির সঙ্গে কিছু মিল ছিল—খুশিখুশি, বিষণ্ন কিন্তু সরল। নোরার ক্ষেত্রে পরিচালক তাঁকে ‘আরও গভীর আবেগের ভারে ভারী করেছেন।’
বড় হওয়ার গল্প
নরওয়ের এক প্রত্যন্ত এলাকায় রেনেতের বেড়ে ওঠা—বনের মধ্যে কিছু বাড়ি আর একটি রাস্তা। নিজেকে সব সময় বেমানান মনে হতো। তিনি বন্ধুদের ব্যাকস্ট্রিট বয়েজে মগ্ন থাকতেন, আবার গোপনে পিঙ্ক ফ্লয়েডও শুনতেন।
বাস্তব জীবনে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এত ভুল করতেন যে স্কাউটস থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়; পারিবারিক নির্মাণ ব্যবসা করতে পারেননি কারণ নিয়ম মানতে পারতেন না। ১৬ বছর বয়সে একাই থাকতেন। ১৪ বছরে কেউ এসে বলেছিল—থিয়েটার স্কুলে আবেদন করতে। পেশা হিসেবে অভিনয়ের ভাবনায়—নিজেকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন।
তারপর রেনাতে সবকিছু থেকে পালালেন। ১৭ বছরে এডিনবরায় পৌঁছান। হোস্টেল-রেস্তোরাঁ-বারে ডাবল শিফট কাজ; নানা সংস্কৃতির মানুষের সান্নিধ্য, পার্টি—সবই ভালো লেগেছে। তবে ব্রিটিশ রসিকতা বোঝা কঠিন ছিল। নরওয়েতে ফিরে নাট্যশিক্ষা নিয়ে এক দশক মঞ্চে কাজ করেন। নরওয়েজিয়ান থিয়েটার উচ্চমানের হলেও তিনি নিজেকে শেষ প্রান্তে মনে করেন। ছবির প্রস্তাবও মনমতো আসছিল না। তাই কাঠমিস্ত্রি হওয়ার কথাও ভেবেছিলেন, একটি জরাজীর্ণ বাড়ি সংস্কার করতে ভালো লেগেছিল বলে।
রেনাতের অজান্তেই ত্রিয়ের তাঁকে ভেবেই লিখছিলেন। ২০১১-এর ‘অসলো, অগাস্ট ৩১’-এ ক্ষণিকের উপস্থিতি থেকেই তিনি নির্মাতা তাঁর সম্ভাবনায় নিশ্চিত ছিলেন। অভিনয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক-দুদিনের মধ্যেই ত্রিয়ের ফোন করেন জুলি চরিত্রের জন্য। এভাবেই জীবন বদলে যায়।
শৈশবের বিচ্ছিন্নতার পর আজ তিনি আলোচনার কেন্দ্রে। ‘এই অনুভূতিটা কী—আমি জানি না,’ বলেন তিনি।
দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে