প্রেম ও দ্রোহের গল্পে সাজানো ২৬তম টোকিও ফিল্মেক্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
শরতের টোকিও যেন এক অন্তহীন চলচ্চিত্র নগরী, সারা বিশ্ব থেকে আসা নির্মাতা-অভিনেতা, চলচ্চিত্র বোদ্ধা কিংবা সাধারণ দর্শকদের পদচারণ ও মিথস্ক্রিয়ায় মুখর সর্বদা যার সড়ক-সিনেমা হল। একটি উৎসব শেষ হতে না হতেই শুরু হয় পরের আয়োজন, যদিও আদল আর আমেজে থাকে ভিন্নতা। আন্তর্জাতিক থেকে দেশীয়, ফিকশন থেকে ডকুমেন্টারি, লাইভ অ্যাকশন থেকে অ্যানিমেশন—একেক আয়োজনের রয়েছে একেক কেন্দ্রবিন্দু। টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হতে না হতেই গত ২১ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত নগরীর ইউরাকুচো এলাকায় অনুষ্ঠিত হলো ২৬তম টোকিও ফিল্মেক্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। মূলত এশীয় চলচ্চিত্রের ওপর আলোকপাত করা এই উৎসবে নিজ দেশ বা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসরত এশীয় নির্মাতাদের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এশীয় চলচ্চিত্রের মধ্যেই গণ্ডি সীমিত রাখলেও ফিল্মেক্স টোকিওর একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব। এতে চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক ও সমালোচকদের পাশাপাশি বোদ্ধা দর্শকদের উপস্থিতিই মূলত বেশি।
উৎসবের ইতিহাস ও লক্ষ্য
বিশ্বখ্যাত জাপানি অভিনেতা-পরিচালক তাকেশি কিতানোর প্রতিষ্ঠান ‘অফিস কিতানো’র উদ্যোগে ২০০০ সালে এই চলচ্চিত্র উৎসবের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে অলাভজনক সংগঠন ‘টোকিও ফিল্মেক্স আয়োজক কমিটি’র উদ্যোগে এটি আয়োজিত হয়। এতে সহযোগী হিসেবে থাকে জাপান সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক এজেন্সি, আর্টস কাউন্সিল-টোকিও, ইনস্টিটিউট দ্য ফ্রান্স, জাপান ও নিউইয়র্ক–ভিত্তিক প্রযোজনা কোম্পানি ‘সিনেমা ইউনিটাইল’সহ অন্যান্য সংস্থা।
‘চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের’ ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলা টোকিও ফিল্মেক্সে সাধারণত স্বাধীন ও নিরীক্ষাধর্মী কাজের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। দর্শকেরা এতে ব্যতিক্রমী নির্মাণ অথচ মূলধারার সিনেমা হলে অপ্রদর্শিত বা কম প্রদর্শিত উঁচুমানের ফিকশন ও তথ্যচিত্রসহ বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র ধারা এবং আঙ্গিকের দেখা পান। সিনেমার মাধ্যমে আন্তসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ মননের সমাজ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য ফিল্মেক্সের। তাই ফিল্মেক্স এমন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমর্থন করে, যাঁরা এশিয়ার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে বড় পর্দায় নিয়ে আসেন।
এবারের উৎসবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি আরও ছিল দর্শকদের উপস্থিতিতে নির্মাতা, প্রযোজক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্ব। ছিল আলোচনা ও রিসেপশনসহ চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নানান মিথস্ক্রিয়ার ব্যবস্থা। উদীয়মান নির্মাতাদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত ফিল্মেক্সে আরও যুক্ত ছিল ‘ট্যালেন্টস টোকিও’ নামক একটি নতুন প্রতিভা উন্নয়ন কর্মসূচি, বার্লিনেল ট্যালেন্টসের সঙ্গে রয়েছে যার সংশ্লিষ্টতা।
বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের সমাহার
ইউরাকুচোর আসাহি ও হিউম্যান ট্রাস্ট সিনেমা হলে আয়োজিত এবারের ২৬তম ফিল্মেক্সের প্রতিযোগিতা বিভাগে চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া, ইরান এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশের মোট ১০টি ছবি অংশ নিয়েছে। এর বাইরে ‘বিশেষ প্রদর্শনী’ বিভাগে ছিল আমন্ত্রিত আরও সাতটি ছবি, যেগুলো ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের উৎসবগুলোয় আলোড়ন তুলেছে। ‘ফিল্মমেকার ইন ফোকাস’-এ ছিল আর্জেন্টিনার পরিচালক লুক্রেসিয়া মার্টেল ও সুইজারল্যান্ডের নির্মাতা র্যামন জুরকারের তিনটি করে চলচ্চিত্র। অন্যদিকে ‘মেড ইন জাপান’ বিভাগে দেখানো হয়েছে শিগায়া দাইসুকের ‘লিভ দি ক্যাট অ্যালোন’ ও যাঙ ইয়াওইউয়ানের নর্থইস্টার্ন শর্ট কালেকশন নামে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রমালার তিনটি চলচ্চিত্র। এর আগে নভেম্বরের ১৪ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত প্রি-ইভেন্ট হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে হংকংয়ের তিনটি চলচ্চিত্র। এগুলো হচ্ছে পরিচালক তাং শুশুয়েনের ‘দি আর্চ’ (১৯৬৮), পিটার ইউংয়ের ‘দি সিস্টেম’ (১৯৭৯) ও প্যাট্রিক ট্যামের লাভ ম্যাসাকার (১৯৭১)।
ব্যক্তিগত ট্রমা, প্রেমের দ্বন্দ্ব, তারুণ্যের দ্রোহ, শ্রমিকের সংগ্রাম, অভিবাসন, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ, কিংবা জাতীয় মুক্তির লড়াই—এ রকম বৈচিত্র্যময় বিষয়ের চলচ্চিত্র নিয়ে এবার হাজির হয়েছিলেন সারা বিশ্ব থেকে এশীয় ও এশীয় বংশোদ্ভূত নির্মাতারা। এ প্রসঙ্গে ‘প্রথম আলো’র আলাপ হয় ফিল্মেক্সের প্রোগ্রামিং ডিরেক্টর কামিয়া নাওকির সঙ্গে। উৎসবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়-বৈচিত্র্যের উল্লেখ করে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কোনো থিম মাথায় রেখেছেন কি না? জবাবে কামিয়া বলেন, ‘বিশেষ কোনো বিষয় বা থিম নিয়ে আমি ভাবিনি, বরং একেকজন চলচ্চিত্র পরিচালকের নিজস্ব নির্মাণশৈলীর অনন্যতার ওপর নজর দিয়েছি। তাই বিষয়ের মধ্যে এমন ভিন্নতা এসেছে।’ প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র এবার জমা পড়েছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি একাধিক চলচ্চিত্র জমা পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে এবার সফল না হলেও ভবিষ্যতে সেগুলো সাফল্যের মুখ দেখবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন কামিয়া।
এবারের প্রতিযোগিতা বিভাগের চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে—দক্ষিণ কোরীয় নির্মাতা ইউন গা-ইউনের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব লাভ’, তাইওয়ানি পরিচালক সু-কি’র প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গার্ল’, কোরীয়-কানাডীয় নির্মাতা লয়েড লি চোইয়ের ‘লাকি লু’, জর্জিয়ান পরিচালক আলেকজান্দ্রে কোবেরিডজের ‘ড্রাই লিফ’, প্যারিস নিবাসী জাপানি বংশোদ্ভূত পরিচালক আকিহিরো হাতার ‘সাইট’, তাইওয়ানি-মার্কিন পরিচালক সু শিহ-চিংয়ের ‘লেফট হ্যান্ডেড গার্ল’, ইরানি নির্মাতা আমির আজিজির ‘ইনসাইড আমির’, সিঙ্গাপুরীয় পরিচালক তান সু-ইউর ‘অ্যামিবা’, জাপানি নির্মাতা তাকুইয়া উচিয়ামার ‘নাম্ব’ এবং ভারতীয় পরিচালক রোহান পরশুরাম কানাওয়াডের ‘ক্যাকটাস পিয়ার্স’। প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চীনা চলচ্চিত্র পরিচালক সং ফ্যাং, সুইজারল্যান্ডের চলচ্চিত্র পরিচালক র্যামন জুরচার ও আর্জেন্টিনার চলচ্চিত্র পরিচালক মাতিয়াস পিনেইরো।
গ্র্যান্ড প্রাইজ ও প্রতিযোগিতা বিভাগ
প্রতিযোগিতা বিভাগে অন্য নির্মাতাদের চমৎকার সব চলচ্চিত্রকে টপকে এবার সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্র্যান্ড প্রাইজ জিতে নিয়েছে ভারতীয় নির্মাতা রোহান পরশুরাম কানাওয়াডের মারাঠি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ক্যাকটাস পিয়ার্স’। পিতৃবিয়োগের ১০ দিনব্যাপী সামাজিক শোকপালনের রীতি অনুসরণ করে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়া মুম্বাইনিবাসী এক তরুণ আনন্দের সঙ্গে তার বাল্যবন্ধু বালিয়ার পুনর্মিলন এবং ক্রমশ তা একটি বিশেষ সম্পর্কে রূপ নেওয়ার গল্প এটি। বিশেষ করে, ভারতের মতো একটি সংস্কারপূর্ণ দেশে সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেমের সম্পর্ক এবং এ–সংক্রান্ত সামাজিক ও পারিবারিক টানাপোড়েনের শৈল্পিক ও পরিমিত উপস্থাপনা মন জয় করে নিয়েছে জুরিদের। পুরস্কার প্রদানের কারণ হিসেবে জুরিরা বলেন, মূলত ‘নিপীড়ন ও ধর্মীয় অনমনীয়তায় পরিপূর্ণ সমাজে দুই যুবকের ঘনিষ্ঠ হওয়ার গল্প এটি। এই চলচ্চিত্র একটি সংবেদনশীল চিত্রনাট্য ও সুনির্দিষ্ট দৃশ্যমান ভাষায় তৈরি। এতে চিত্রিত গল্পের মৌন গাঁথুনিতে রয়েছে সব বৈচিত্র্যময় অবস্থানকে ধারণ করতে পারার মতো মুক্ত এক বিশ্বের প্রতি জোরালো আকাঙ্ক্ষা।’ চলচ্চিত্রের শেষভাগে, মুম্বাইয়ের ঘরে ফেরার পর পিতা হারানো আনন্দের কান্না ও তাঁকে বালিয়ার সান্ত্বনা প্রদানের দৃশ্যে অবশ্য বৈচিত্র্য থেকে মানবিকতাই বড় হয়ে ওঠে। মুম্বাইয়ের বস্তিতে গাড়িচালক পিতা ও গৃহিণী মায়ের ঘরে বড় হওয়া পরিচালক রোহান স্বশিক্ষিত একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করলেও একপর্যায়ে ঝুঁকে পড়েন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণে। এর আগে ‘বিউটিফুল’ (২০১৬), ‘উইন্ডো’ (২০১৭) ও ‘ইউ ফর উষা’ (২০১৯)-এর মতো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও ‘ক্যাকটাস পিয়ার্স’ তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছবিটি এর আগে সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসবেও গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কার জিতে নিয়েছিল।
এবারের ফিল্মেক্সে বিশেষ জুরি পুরষ্কার পেয়েছে জাপানি নির্মাতা তাকুইয়া উচিয়ামার ‘নাম্ব’। জাপানের বরফাচ্ছাদিত নিগাতা জেলায় ধারণ করা এই চলচ্চিত্রে পারিবারিক দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে শৈল্পিক নির্মাণে। উচিয়ামা তাকুইয়ার চতুর্থ এই পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপাদান, যা মূলত সন্তানের ওপরে মা–বাবার অন্তর্দ্বন্দ্বের নিদারুণ প্রভাবের গল্পকে তুলে ধরে। শিশুবয়সে রূঢ় পিতার আচরণে মূক হয়ে পড়া দাইচির সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক এখন যেন ভালোবাসা ও ঘৃণায় মোড়া এক ধোঁয়াশা। দর্শক হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার চিত্রায়ণে অনুসরণ করে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে নিজ শহরে ছুটে চলা পরিণত বয়সী দাইচির যাত্রা। জাপানের জনপ্রিয় অভিনেতা কিতামুরা তাকুমি এই চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন। পরিশেষে, বাবার সঙ্গে পুনর্মিলনের সুবাধে বেদনাদায়ক অতীতের মুখোমুখি হওয়া দাইচি ফিরে পায় তার হারিয়ে যাওয়া ‘কণ্ঠস্বর’। জুরিদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘এটি এমন এক চলচ্চিত্র, যা নীরবতা ও পারিবারিক সহিংসতার শীতল পরিবেশকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি জীবনের এক অনন্য উষ্ণতার সন্ধানও দেয়...দেখায় ভবিষ্যতের আলোর ঠিকানা।’
এদিকে এবারের ‘স্পেশাল ম্যানসন’ পুরস্কার জিতে নিয়েছে জর্জীয় পরিচালক আলেকজান্দ্রে কোবেরিডজের ‘ড্রাই লিফ’। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত জুরি প্যানেলের ‘স্টুডেন্ট জুরি অ্যাওয়ার্ড’ও জিতেছে ছবিটি। গত বছরও গ্র্যান্ড প্রাইজ জিতে নিয়েছিল আরেক জর্জীয় পরিচালক দিয়া কুলুমবেগাসভিলির নির্মিত ‘এপ্রিল’। ‘ড্রাই লিফ’ মূলত লিসা নামক একজন ক্রীড়া আলোকচিত্রীর অকস্মাৎ অন্তর্ধান ও তাঁর সন্ধানে বাবা ইরাকলির নানান জায়গায় হন্যে হয়ে ছুটে চলার গল্প। লিসার কর্মক্ষেত্রের বন্ধু লেভান (চলচ্চিত্রে শারীরিকভাবে অদৃশ্য, উপস্থিত শুধু কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে) ইরাকলির অনুসন্ধানী যাত্রায় শামিল হন। লিসার সম্ভাব্য গন্তব্য অনুসরণে জর্জিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণের সময় তাঁরা বিচিত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির পাশাপাশি মুখোমুখি হন অপরিচিত নানা ব্যক্তির। পরিচালকের ভাই গিওর্গি কোবেরিডজের চমৎকার মিউজিক, ক্যামেরায় ধারণকৃত গ্রামীণ প্রাকৃতিক দৃশ্যপট, বিভিন্ন সাক্ষাৎ ও কথোপকথন, ব্রেখটিয়ান কমেন্টারি—সব মিলিয়ে উদ্বেগের আবহ ছাপিয়ে তাঁদের যাত্রা কখনো কখনো হয়ে ওঠে নান্দনিক চিত্রের সমাহার। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম স্বতন্ত্র দিক ছিল এর চিত্রধারণ। এতে ব্যবহৃত হয়েছে ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকের সেলফোন ক্যামেরা। এই কম রেজল্যুশনের নান্দনিকতা অতীত ও বর্তমানের সীমানাকে যেমনি অস্পষ্ট করে, তেমনি গড়ে তোলে বাস্তবতা এবং জাদুবাস্তবতার সম্মিলিত এক জগৎও। জুরিদের ভাষ্য, ‘এই ছবির মৌলিকত্ব ও অনুসন্ধানী মনোভাব আমাদের গভীরভাবে মুগ্ধ করেছে। এর অনন্য সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি, কাব্যিক দৃশ্যমান ভাষা ও প্রায় মেডিটেশনের মতো গল্প বলার ধরনে পরিস্ফুট হয়েছে চলচ্চিত্রের অকৃত্রিম আকর্ষণ।’
এবারের ‘দর্শক পুরস্কার’ পেয়েছে তাইওয়ানি-মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা সু শিহ-চিং–এর ‘লেফট হ্যান্ডেড গার্ল’। তাইপের পটভূমিতে শিশু ও কিশোরী দুই তরুণীকে ঘিরে মা এবং বর্ধিত পরিবারের নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট কমিক ঘরানায় উপস্থাপিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এর উল্লেখযোগ্য দিক ছিল মার্কিন নির্মাতা ও সম্পাদক সন বেকারের চমৎকার সম্পাদনা।
তবে প্রতিযোগিতা বিভাগে অন্য যে বিশেষ ছবিটি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের নজর কেড়েছে, সেটি হচ্ছে কোরীয়-কানাডীয় নির্মাতা লয়েড লি চোই-এর ‘লাকি লু’। এই চলচ্চিত্রে বিখ্যাত তাইওয়ানিজ অভিনেতা চ্যাং চেন মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে চীন থেকে নিয়ে আসার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলার দিনই নিউইয়র্কের একজন মালামাল সরবরাহকারী চীনা কর্মী লু জিয়া চেং-এর জীবনে ঘটে যায় এক দুঃখজনক ঘটনা। তাঁর উপার্জনের একমাত্র উপায় বৈদ্যুতিক বাইকটি সেদিন চুরি হয়ে যায় ফুটপাত থেকে। অন্যদিকে একজন ভুয়া দালাল তাঁর বাড়ি ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ করে। এই চলচ্চিত্রে পরিচালক চোই, নিউইয়র্কে জীবিকা নির্বাহে নিরন্তর সংগ্রামরত নিম্ন আয়ের চীনা বাসিন্দাদের একটি করুণ-অদেখা জগৎকে চিত্রিত করেছেন। এই চলচ্চিত্রের ক্যামেরা সব সময় রাস্তার সমান্তরালে চলে, নিউইয়র্কের প্রাচুর্য কিংবা বিশালাকারের দালানগুলো যেখানে অনুপস্থিত। চায়নাটাউনের আধো-অন্ধকার গলিতে চিত্রিত লু–এর ইমেজ যেন রং-হীন বিষণ্ণতায় মোড়া নিষ্ঠুর শহরের প্রতিচ্ছবি। এ চলচ্চিত্রে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে চ্যাং চেনের সংবেদনশীল অভিনয় জয় করেছে দর্শকহৃদয়। গল্পের গাঁথুনিতে পরিচালক লু ও তাঁর শিশুকন্যাকে দাঁড় করান এক বিপ্রতীপ অবস্থানে, যেখানে শিশুর সারল্য ও বাস্তব জগতের নিষ্ঠুরতায় দান্দিক এক জগতের অবতারণা ঘটে। দারিদ্র্য ও নির্মমতার কশাঘাতে পূর্ণ লু’র কঠোর পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত ছোট্ট শিশুটির মুখই যেন আশার আলো। তার ছোট ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো টেবিলে রেখে মেয়েটি যখন বাবাকে বলে, ছবিগুলোর ধারাবাহিকতা পরিবর্তন করে যদি ভিন্নভাবে সাজাও, তাহলে পাল্টে যাবে পুরো গল্পটাই। এ যেন যে ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে আমাদের এই নিপীড়নমূলক সমাজ, সেটি পাল্টে দেওয়ার আহ্বান ছোট্ট শিশুটির মুখ দিয়ে চলচ্চিত্রকারের স্বয়ং।
চলচ্চিত্রে ভালোবাসা ও মানবিকতার জয়গান: আমন্ত্রিত চলচ্চিত্রগুলো
উৎসবের উদ্বোধনী ও সমাপনীসহ অন্যান্য আরও কিছু চলচ্চিত্র ছিল বিশেষভাবে আমন্ত্রিত, নির্মাণের মুনশিয়ানা এবং বার্তার গভীরতায় চলতি বছর অন্যান্য চলচ্চিত্র উৎসবে, যা ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এমন একটি চলচ্চিত্র ছিল চীনা নির্মাতা সাই সানজুনের অনবদ্য ‘দি সান রাইসেস অন আস অল’। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিচ্ছিন্ন হওয়া সাবেক দম্পতি মেয়ুন এবং বাওশু অকস্মাৎ মুখোমুখি হয় সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ এক পরিস্থিতির। মেয়ুনের জীবনে রয়েছে এখন নতুন প্রেমিক, যার সন্তান তার গর্ভে। কিন্তু যখন সে জানতে পারে যে সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া স্বজনহীন বাওশু চতুর্থ পর্যায়ের ক্যানসারে আক্রান্ত, তখন সে তাকে তার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসে দেখভালের জন্যে। দুজনের নানা সংলাপে অবশেষে জানা যায়, মূলত মেয়ুনকে বাঁচাতেই নিজে কারাগারে গিয়েছিল বাওশু। অথচ কারাবাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সে দেখে মেয়ুন তাকে পরিত্যাগ করে বেছে নিয়েছে নতুন প্রেমিক। নতুন বাস্তবতায় তাদের মাঝে গড়ে ওঠে পারস্পরিক অদ্ভুত এক সম্পর্ক। মেয়ুন বাওশুকে সেবা করার মধ্যে দিয়ে শোধ করতে চায় পুরোনো ঋণ। অন্যদিকে বাওশু প্রচণ্ড ভালোবাসা ও ঘৃণার দ্বৈরথে ধুঁকে ধুঁকে মরে। ক্রমশ এই গল্প এমন এক পরিণতির দিকে এগোয়, যার জন্য দর্শকের থাকে না কোনো আগাম প্রস্তুতি। মূলত দুটি চরিত্রের আবেগগত নানা ওঠানামাকে বাস্তবধর্মী চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে পরিচালক সাই পর্দায় এক অবিশ্বাস্য টানটান জগৎ গড়ে তোলেন। পুরো চলচ্চিত্র যেন ধীরে ধীরে জমতে থাকা আবেগের ধারক, যা শেষ দৃশ্যে গিয়ে বিস্ফোরিত হয় এবং নিজের অজান্তেই অশ্রুসিক্ত দর্শক অনুধাবন করেন মানুষের ভালোবাসা কত গভীর, নিষ্ঠুর, বৈচিত্র্যময় কিংবা সুন্দর হতে পারে। আর এই অব্যক্ত রসায়ন ধারণ করার অনন্য ক্ষমতা কেবল যে চলচ্চিত্রেরই রয়েছে, পরিচালক সাই সানজুনের ‘দি সান রাইজেস অন আস অল’ যেন তার জ্বলজ্বলে সাক্ষ্য।
ফিল্মেক্সে প্রদর্শিত আরেকটি নির্মাণের কথা না বললেই নয়। সেটি হচ্ছে ‘পুট ইউর সউল অন ইওর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াক’ নামক অবরুদ্ধ গাজার বাস্তবতা তুলে ধরা এক অনন্য তথ্যচিত্র। প্রতিনিয়ত বোমা হামলার শিকার ও ক্ষুধার সঙ্গে অবিরাম লড়াইরত একদল সাহসী মানুষের বেঁচে থাকার গল্প এটি। ফিলিস্তিনের গাজায় বসবাসকারী তরুণী ফটোসাংবাদিক ফাতমা হাসোনা ও ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা সেপিদেহ ফারসির মধ্যে স্মার্টফোনের মাধ্যমে চলা এক বছরের ভিডিও কল দিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্র। টেলিসংযোগের নানা বিঘ্ন উপেক্ষা করে হাসোনা শুনিয়ে যায় তার গল্প। ভাগাভাগি করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত জনপদের হৃদয়বিদারক ছবি, আবৃত্তি করে কবিতা। কখনো গোধূলির আকাশ, পরিবারের সদস্যদের বয়ান এবং যুদ্ধে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের গল্প উঠে আসে তার ভিডিওকলে। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থেকেও কেমন হাসিমুখে চালিয়ে যায় সে নিত্যকার জীবন-সংলাপ। অবশেষে, তাদের এই যৌথ চলচ্চিত্র প্রচেষ্টা নির্বাচিত হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। হাসোনার একান্ত ইচ্ছে ছিল এতে যোগ দেওয়ার। সে রকম প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সুসংবাদ পাওয়ার পরের দিনই পরিবারের অন্যান্য বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে নিজ বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয় হাসোনা। তার এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু যেন এই সিনেমাকে দেয় আরও গভীর তাৎপর্য, তুলে ধরে যুদ্ধের বীভৎসতার ইতিহাস। অন্যদিকে এই চলচ্চিত্র যেন মানুষের অমানবিকতার বিপরীতে মুক্তির লক্ষ্যে সাহসী বীরদের আমৃত্যু লড়ে যাওয়ারই গল্প। চলচ্চিত্র ও স্বাধীনতার স্বপ্ন যেখানে হাত ধরাধরি করে চলে।
টোকিওর উৎসবগুলোয় তাই চলচ্চিত্র শুধু যাপিত জীবন বা উপভোগের সীমায় আটকে থাকেনি এবার। বরং সত্যিকার অর্থেই একটি সংস্কার-শোষণ-নিপীড়ন ও প্রতিবন্ধকতাবিহীন সমাজ অর্জনের লড়াইয়ে দৃশ্যমান হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে। ৯ দিন ধরে চলা ২৬তম টোকিও ফিল্মেক্সও যেন একাধারে প্রেম-দ্রোহ, প্রত্যাশা-অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন আর সংগ্রামের যৌথ বুননে চলচ্চিত্রের শক্তিশালী ভাষারই অনন্য উদ্যাপন।