এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না

আঁকা: রাজীব

মাঝেমধ্যেই অনিদের বাসায় থাকতে আসি আমি। বিশেষ করে পরীক্ষার রেজাল্টের পর। রেজাল্ট এমন একটা জিনিস, যেটা প্রকাশিত হলেই বাসায় খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় আমাকে। মাত্র দুটি সাবজেক্টে ‘সি’ পেলেও এমন ভাব করে সবাই, যেন আমি ছাত্র নই, চোর। মুরগি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছি। তা-ও দেশি মুরগি না, নিরীহ টাইপ ফার্মের মুরগি। এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে অনিদের বাসাই ভালো, এখানে কেউ সিজিপিএ নিয়ে মাথা ঘামায় না।

নিজের ঘরে রিমোট দিয়ে একের পর এক চ্যানেল বদলাচ্ছে অনি। আমাকে দেখে মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘দেখার কিছু নাই টিভিতে।’

এটা ওর অভ্যাস। নিজে টিভি দেখবে না, দেখতে দেবে না অন্যকেও। কিন্তু ঠিকই পলিটিশিয়ানদের মতো রিমোটের দখল রাখবে নিজের কাছে। আমি বললাম, ‘মনটা খুব খারাপ। আমার কনফিডেন্স ভেঙে গেছে।’

‘কখন ভাঙল? আওয়াজ পেলাম না তো।’

‘আরে ধুর। সত্যি, আমাকে দিয়ে মনে হয় কিছু হবে না।’

‘তা ঠিক। রেজাল্ট নিয়ে হতাশ নাকি? তুই তো নায়ক ওমর সানী না যে প্রতি পরীক্ষার পর ছুটে এসে বলবি, “মা মা, আমি ফার্স্ট হয়েছি!” অন্য ঘটনা আছে নাকি?’

‘আরে, এত কিছু করেও ভালো লাগার কথাটা শ্বেতাকে বলতে পারলাম না তো। সাহসই হয় না। কথা আটকে যায়।’

‘তুইও শ্বেতার মতো তোতলা নাকি?’

‘ও তোতলা না। কথা একটু আটকে যায় এই আরকি। প্রেজেন্টেশনের সময় তো তোরও কথা আটকায়। তোকে কি খ্যাপাই? এমনিতে মানুষ হিসেবে ও খুব ভালো।’

‘যে মেয়ে পরীক্ষার হলে প্রশ্নের পেছনে পয়েন্ট লিখে দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাকে ভালো মানুষ বলা যায় না। তুই ওকে ভুলে যা রিয়াদ। ওর সঙ্গে প্রেম করে তোর ফায়দা কী? ও কখনো তোর অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন করে দেবে না। ভোর চারটায় ঘুম থেকে ডেকে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।’

‘অ্যানিমেল প্ল্যানেট দেখে দেখে তুইও অ্যানিমেল হয়ে যাচ্ছিস। ছাগল। হেল্প করবি কি না বল।’

‘না। চিন্তা কর, পয়েন্ট না-ই বা লিখল, অন্তত মুখে বলত...তখন অবশ্য ৫টা পয়েন্ট শুনতে দুই ঘণ্টা চলে যেত হে হে...’

২.

আমি বেরিয়ে এলাম। যা করার আমাকেই করতে হবে। নিজের প্রেম নিজে করো। যদিও অতীতের প্রতিটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। একবার ফেসবুকের মতো বাস্তবেও ফলো করতে গিয়েছিলাম শ্বেতাকে। হাতে চকলেট, বই। হঠাৎ একটা গাড়ি এমনভাবে কোণঠাসা করল আমাকে, সাইড দিতে গিয়ে আচমকা পার্শ্ববর্তী ড্রেনে পড়ে গেলাম। ওই অবস্থায় কি আর ভালোবাসার কথা বলা যায়?

পরে একদিন সাহস করে সামনে গেলাম। শ্বেতাও বলছিল, ‘কী...কিছু বলবে?’ আমি বেশ ভাব নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। সিজিপিএ কত তোমার?’

তারপর এই তো সেদিন, চিরকুট রেখে দিলাম ওর ব্যাগে। কয়েক সপ্তাহ চলে গেল, কোনো উত্তর নেই। পরে জানলাম, সেদিনই রিকশা থেকে টান দিয়ে ওর ব্যাগ নিয়ে গেছে ছিনতাইকারী! সমবেদনা জানাতে ওর বাসায় গিয়ে চা-মিষ্টিও খেয়ে এলাম, তবু কথাটা বলতে পারলাম না। কারণ শ্বেতার বাবাও ছিলেন তখন। পেশায় তিনি অতিরিক্ত সচিব। কথাও বলেন অতিরিক্ত। এ জন্যই বোধহয় কথায় আছে, অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো না।

এমন সময় অনি এসে বলল, ‘তোর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো। একটা বুদ্ধি পেয়েছি। শোন...।’

অনির বুদ্ধিটা অসাধারণ, কিন্তু এটা প্রয়োগ করা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ। এমনিতেই আমার আত্মবিশ্বাস কম। তার ওপর এত কিছু কী করে করব ভেবে পাচ্ছি না। অবশ্য আমার কিছু করতে হলো না। অনিই করল সবকিছু। এমনকি ‘বেড়াতে যাব’ বলে শ্বেতাকেও রাজি করাল সে। আঙ্কেলের গাড়িটা ম্যানেজ করল। কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়েও প্রস্তুত, শ্বেতা বাসা থেকে বেরোলেই যারা ফুল বাড়িয়ে দেবে ওর দিকে। শ্বেতার পছন্দের গানগুলো জোগাড় করা হলো। গাড়িতে উঠলেই সেগুলো বাজতে থাকবে একের পর এক। তারপর আমরা সোজা চলে যাব ৩০০ ফুটের কাছাকাছি। সেখানেই মূল আয়োজন।

শ্বেতার বাসার সামনে গাড়িতে বসে আছি অনি আর আমি। গেটের কাছেই ফুল হাতে পজিশন নিয়েছে বাচ্চারা। কিন্তু শ্বেতার দেখা নেই। সুযোগ পেয়ে ফেসবুকে মনোযোগ দিয়েছিলাম আমরা, আর তখনই কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে গেল ঘটনাটা। শ্বেতাদের বাড়ি থেকে বের হওয়া এক তরুণীকে শ্বেতা ভেবে ফুল বাড়িয়ে দিল বাচ্চাগুলো। ‘ওই ভাইয়ে দিসে’ বলে দেখিয়েও দিল আমাদের। তরুণীর অগ্নিদৃষ্টি দেখে সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি নিয়ে চম্পট দিলাম আমরা। এই বাসায় সব ভিআইপি লোকজন থাকে, ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ওদিকে শ্বেতা এসে ফোন দিতে লাগল একটানা। একটু ঘুরেই আবার ফিরে এলাম আমরা। গাড়িতে উঠল শ্বেতা। এখনই একে একে অর্ণব, মেঘদলের গান বেজে ওঠার কথা। কিন্তু কী আশ্চর্য! ঘরঘর আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বের হলো না স্পিকার থেকে। বিভিন্ন সুইচে নাড়াচাড়া দিয়ে অনি খুব চেষ্টা করল, লাভ হলো না কোনো। শ্বেতা বলল, ‘গা...গা...’

‘গাধা!’ কথাটা শেষ করলাম আমি।

‘গা...গান না হলে সমস্যা নেই, গ...গল্প করতে করতে যাই...।’

তা-ই যাচ্ছিলাম। সুন্দর আবহাওয়া। শুধু ‘গাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার সময় গান না শোনাই যে ভালো’, তা নিয়ে খুব লেকচার দিচ্ছিল অনি। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তুই থামবি?’

‘থামাতেই হবে রে।’ বলল অনি। ‘তবে লেকচার নয়, গাড়ি। সার্জেন্ট সিগন্যাল দিয়েছে।’

সত্যিই দেখি আম্পায়ারের মতো হাত বাড়িয়ে রেখেছে সার্জেন্ট। তারপর আর কী, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ঠুকে দিল একটা মামলা। দোষটা আমারই। সিটবেল্ট যে বাঁধিনি, সেই খেয়ালই ছিল না আমার। নজিরবিহীন উপায়ে প্রেমের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছি, এ সময় কি সিটবেল্টের কথা মনে থাকে?

উপায়টা ঠিক নজিরবিহীন নয়, তবে অভিনব। নাটক-ফেসবুকে দেখে এই বুদ্ধি দিয়েছে অনি। ৩০০ ফুটের রাস্তায় একদিনের জন্য একটা বিলবোর্ডের ব্যবস্থা করেছে ও। ওর এক পরিচিতের বিলবোর্ড ব্যবসা। বিলবোর্ডে লেখা থাকবে, ‘ভালোবাসি শ্বেতা’। খুবই নাকি কার্যকর পদ্ধতি, দেখলেই মন দ্রবীভূত হয়ে যাবে শ্বেতার।

নির্ধারিত স্থানে গিয়ে দেখি, মানুষের জটলা। গাড়িটারি সব আছে, কিন্তু কোনো বিলবোর্ড চোখে পড়ল না। আমরা নিশ্চিত যে ভুল জায়গায় এসেছি। একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল অনি,

‘এখানে একটা বিলবোর্ড ছিল না?’

‘আছিল। সিটি করপোরেশন আইসা ভাইঙ্গা ফালাইছে।’

‘কখন?’

‘আইজ সকালেই।’

নির্বাক হয়ে গেলাম আমি। হিন্দি সিরিয়াল হলে এখন নিশ্চিতভাবেই পরপর তিনবার বজ্রপাতের আওয়াজ হতো। খুব হতাশ লাগছিল। কোনো সাবজেক্টে এফ পেলেও এতটা হতাশ হই না আমরা। আমাদের দেখে শ্বেতা তো অবাক। বিস্মিত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘একটা বিলবোর্ড দেখতে এত দূর এলাম?’

‘হু। মিডিয়া স্টাডিজের শিক্ষার্থীদের জন্য বিলবোর্ড দেখা জরুরি।’

‘ওটায় কী ছিল?’

‘কী আর, বিজ্ঞাপন!’

৩.

শ্বেতাকে পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফিরলাম আমরা। কাল থেকে ক্লাস শুরু, বই-খাতা খুলেও দেখিনি এত দিন। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে ওল্টাতে শুরু করলাম বইগুলো। পড়া না হোক, ঘুম তো আসবে, ঘুমেরই দরকার এখন।

হঠাৎ টুপ করে একটা কাগজ পড়ল বই থেকে। কাগজে শুধু লেখা ‘আমিও।’ নিচে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা শ্বেতার নাম। কী অদ্ভুত! তার মানে চিরকুটটা পেয়েছিল ও, যেখানে লিখেছিলাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ সেটার উত্তর দিয়েছে সেই কবে, খেয়ালই করিনি! কিন্তু চিরকুট ও পেল কীভাবে?

মেসেজ পাঠালাম শ্বেতাকে, ‘তোমার না ব্যাগ ছিনতাই হয়েছিল? চিরকুট পেলে কোথায়?’ উত্তর আসতে দেরি হলো না, ‘ওটা আগেই পকেটে রেখেছিলাম। মূল্যবান জিনিস ব্যাগে রাখা ঠিক না। আর তুমি ক্লাসের বইটই পোড়ো একটু, তাহলে আর বিলবোর্ডের কথা ভাবতে হবে না।’

‘মুখে বলনি কেন?’

‘তুমি বলনি কেন? আমার তো কথা আটকে যায়।’

‘আমারও।’

খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেলাম আমি। কথা আটকানো নিয়ে আমার ভয় নেই আর, যেকোনোভাবেই হোক, ওটা বলা হয়ে গেছে। আর একবার যেহেতু বলা হয়ে গেছে, এখন আর কোনো কিছুই আটকাতে পারবে না আমাদের।