৩৯ লাখ টাকা দামের নৌকাগুলো তৈরি হয় ৮ প্রজাতির গাছের কাঠ দিয়ে

জলের ওপর ভেনিস শহর মোহনীয়, কিন্তু গন্ডোলা যাত্রায় তা আরও ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করে
লেখক

লম্বা সরু নৌকাটি স্মৃতিতে কড়া নাড়ল। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা ডন–এর একটি গান দেখছিলাম, সেখানেই প্রথম দেখি গন্ডোলা। তখন অবশ্য নাম জানতাম না। বিদেশ–বিভুঁই তখন স্বপ্ন দেখার বিষয়। গানের দৃশ্যে নদীতে নৌকার মতো কিছু একটা চলছে, সেই নৌকায় একজন হার্প (বাদ্যযন্ত্র) বাজাচ্ছেন, মাঝির কণ্ঠে গান। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টা রূপকথার মতো। তাই যেকোনো পর্যটকের কাছে ভেনিস শহরের গ্র্যান্ড ক্যানেলে গন্ডোলা রাইড দারুণ এক অভিজ্ঞতা। ২০১৮ সালে সেই রূপকথা কিংবা স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। গন্ডোলায় চেপে বসার পর যে অনুভূতি, তার ব্যাখ্যা হতে পারে এ রকম—ইতিহাসের মিষ্টি সুবাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কমনীয়তা আর স্বাপ্নিক ছুটে চলার এক কম্বো প্যাকেজ।

রিয়ালতো সেতুর ওপর দিনমানজুড়ে থাকে পর্যটকের মেলা
লেখক

গ্র্যান্ড ক্যানেল, ভেনিস শহরের সবচেয়ে বড় খাল, যার দুই ধারে গড়ে উঠেছে এই শহর। ভেনিস শহর মূলত একটি দ্বীপ আর এই গ্র্যান্ড ক্যানেল শহরকে দুই ভাগ করেছে। শহরে ঘুরে বেড়ানোর দুটি উপায়—পায়ে হেঁটে আর জলপথে। জলপথে চলাচলের জন্য আছে সি-ট্যাক্সি, ছোট ছোট সি–ট্রাক, সি–বাস আর গন্ডোলা। গ্র্যান্ড ক্যানেলের ওপর চারটি সেতু আছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় সেতুর নাম রিয়ালতো সেতু, যা ভেনিসের কেন্দ্রে অবস্থিত। রিয়ালতো সেতু এবং এর আশপাশের এলাকায় দিনমানজুড়ে থাকে পর্যটকের মেলা।

গন্ডোলা কী?

গন্ডোলাচালকদের বলা হয় গন্ডোলিয়ার
উইকিপিডিয়া

ইতালির ভেনিস শহরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে গন্ডোলার নাম। গন্ডোলা আদতে নৌকা, তবে বিশেষ ধরনের নৌকা। এর চালকদের বলা হয় গন্ডোলিয়ার। গন্ডোলা তৈরি হয় পুরোপুরি হাতে। ব্যবহার করা হয় আটটি ভিন্ন ভিন্ন গাছের কাঠ (লাইম, ওক, মেহগনি, আখরোট, চেরি, ফার, লার্চ ও এলম)। কাঠগুলো কেটেকুটে আবার ২৮০ টুকরা করা হয়। তারপর সব জুড়ে দিয়ে তৈরি হয় একেকটি গন্ডোলা। সময় লাগে প্রায় দুই মাস। আর ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, একেকটি গন্ডোলার দাম পড়ে প্রায় ৩৯ লাখ টাকা!

এখনকার গন্ডোলাগুলো লম্বায় হয় ৩৬ ফুট পর্যন্ত, চওড়ায় ৫ দশমিক ২ ফুট আর ওজন সাড়ে ৩০০ কেজি। গন্ডোলা কেবল একজনই একটি বইঠা দিয়ে চালান। আর চালানোর কৌশলটাও বেশ অন্য রকম। অগভীর পানিতেও গন্ডোলা দিব্যি ছুটে চলে। এর বইঠাটি রাখার জন্য একটি জায়গা আছে, যা ফারকোলা নামে পরিচিত। ফারকোলাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে বইঠাটি চারদিকে ইচ্ছেমতো ঘোরানো যায়।

ইংরেজি বর্ণ ‘এস’-এর মতো দেখতে ফেরোর থাকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রতীক
লেখক

গন্ডোলার সামনের অলংকারটিকে বলা হয় ফেরো (বাংলায় লোহা)। এটি পিতল, স্টেইনলেস স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি। ফেরো একদিকে অলংকারের কাজ করে, অন্যদিকে গন্ডোলারের ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি বর্ণ ‘এস’-এর মতো দেখতে ফেরোর থাকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রতীক। ‘এস’ দিয়ে গ্র্যান্ড ক্যানেলের বাঁক বোঝানো হয়। ওতে চিরুনির দাঁতের মতো ছয়টি পাত থাকে, যা দিয়ে ভেনিসের ছয়টি জেলাকে বোঝানো হয়।

এসব বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাদের গন্ডোলাচালক মার্কো। আমার মনে হলো, গন্ডোলা নামের সাধারণ এক বাহনের মধ্য দিয়ে আমি পুরো ভেনিস শহর দেখতে পেলাম। যদিও গন্ডোলা এখন আর সাধারণ বাহন নয়। গোটা বিশ্বের কাছে ভেনিস শহরের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

আরও পড়ুন

গন্ডোলার ইতিহাস

ভিত্তোরে কারপাচ্চোর আঁকা ‘মিরাকল অব দ্য ক্রস অ্যাট দ্য পন্তে দি রিয়ালতো’ চিত্রকর্মে গন্ডোলা
উইকিপিডিয়া

ভেনিসবাসীর মতে গন্ডোলার ব্যবহার কবে থেকে শুরু হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, প্রায় এক হাজার বছর আগেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন গন্ডোলা শুধু চিত্রকর্মেই দেখা যায় এবং সেগুলো দেখতে এখনকারগুলোর মতো ছিল না। ১৪৯৪ সালে আঁকা চিত্রশিল্পী ভিত্তোরে কারপাচ্চোর ‘মিরাকল অব দ্য ক্রস অ্যাট দ্য পন্তে দি রিয়ালতো’ নামের তৈলচিত্রে প্রাচীন গন্ডোলার দেখা মেলে। প্রাচীন গন্ডোলাগুলো এখনকার তুলনায় ছোট, প্রশস্ত ও মজবুত ছিল। পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে ভেনিসে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কালে ধনী পরিবারগুলো আরও বেশি জাঁকজমকপূর্ণভাবে গন্ডোলাগুলো সাজাতে শুরু করে। ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্লেগ মহামারির পর সরকার শোকের চিহ্ন হিসেবে গন্ডোলাগুলো কালো রং করার আদেশ দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গন্ডোলার ব্যবহার বেড়ে যায়। আকারেও পরিবর্তন আসে, যাতে একজন গন্ডোলিয়ার সহজেই এবং খুব সংকীর্ণ জায়গায় সেটি চালিয়ে নিতে পারেন। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে আনুমানিক ১০ হাজার গন্ডোলা ছিল ভেনিসে, ১৮৭৮ সালে সেই সংখ্যা হয় আনুমানিক ৪ হাজার। ২০১৮ সালে আমি ভেনিস ভ্রমণ করেছি, গন্ডোলিয়ার চালক মার্কো তখন জানিয়েছিলেন, সে সময় ভেনিসজুড়ে ছিল প্রায় ৪০০ গন্ডোলা।

আরও পড়ুন

কোন মেস্তরি নাও বানাইল

সরু খালের ওপরে গন্ডোলা চালানো সহজ কিছু নয়
উইকিপিডিয়া

গন্ডোলিয়ার অর্থাৎ গন্ডোলাচালক হওয়া খুব সহজ কথা নয় কিন্তু। বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রশিক্ষণ ছাড়া ভিনিশিয়ান ইতিহাস, ভেনিসের ভূগোল, বিদেশি ভাষায় দক্ষতা এবং গন্ডোলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহারিক দক্ষতারও পরীক্ষা দিতে হয়। গন্ডোলিয়ারদের বিশেষ পোশাকও আছে; নীল বা লাল ডোরাকাটা শার্ট, লাল রুমাল বাঁধা থাকে গলায়, প্রশস্ত খড়ের টুপি এবং কালো বা নেভি ব্লু প্যান্ট।

গন্ডোলিয়ারদের সম্পর্কে আমার একটি ধারণা ছিল যে সবাই বোধ হয় গন্ডোলা চালানোর সময় দাঁড়িয়ে সেই বিখ্যাত ‘ও সোলে মিয়ো’ গানটি গান। কিন্তু তা একদম নয়। এখনকার বেশির ভাগ গন্ডোলিয়ার গান গাইতে পারেন না। আমাদের চালক মার্কোও পারেন না। ও হ্যাঁ, গন্ডোলা কিন্তু দাঁড়িয়ে চালাতে হয়।

আমাদের রিকশা স্ট্যান্ডের মতো গন্ডোলা স্ট্যান্ডও আছে শহরের প্রতিটি খালে
লেখক

ভেনিস শহরে প্রতিটি ছোট-বড় খালের মোড়ে আছে গন্ডোলা স্ট্যান্ড। আমাদের ঢাকা শহরের রিকশা স্ট্যান্ডের মতো। যেকোনো একটি স্ট্যান্ড থেকে আপনি আপনার ভ্রমণ শুরু করতে পারেন। একটি গন্ডোলায় সর্বোচ্চ ছয়জন বসতে পারে। সময় ধরে গন্ডোলা ভাড়া করা যায়। চাইলে পুরো গন্ডোলা একাই ভাড়া করা যায়। আমি গ্রীষ্মের সময় গিয়েছিলাম ভ্রমণে। সে সময় পর্যটক দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে ভেনিসের অলিগলি, আর গন্ডোলায় তো পর্যটকের অভাব নেই। সরকার থেকে প্রতি যাত্রী ও প্রতি ঘণ্টার দাম নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। গ্রীষ্মকালে গন্ডোলা ভ্রমণ একটু খরুচে, তাই আমি একটি চীনা দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে ঘুরেছি শহরের অলিগলি। পানির ওপর একটি গোটা শহর দেখে বিস্ময়ের সীমা ছিল না আমার।

ভেনিস মানে গন্ডোলা, আর গন্ডোলা মানে ভেনিস
উইকিপিডিয়া

গন্ডোলা ভেনিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, ভেনিস শহরের প্রতীক। জলের ওপর ভেনিস শহর মোহনীয়, কিন্তু গন্ডোলা যাত্রায় তা আরও ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করে। ভেনিস শহরে ঘুরে বেড়ানোর সময় মনে মনে ভাবছিলাম, নদীমাতৃক আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের নৌকাগুলো কি এ রকম আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেতে পারে না? মনে পড়ে, বাউল শাহ আবদুল করিমের সেই প্রিয় গান, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল, কেমন দেখা যায়/ ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়...’।

আরও পড়ুন