ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত করতে চায় রাশিয়া

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর বাকি তিন মাসের মতো। এরই মধ্যে গত শুক্রবার দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এক প্রতিবেদনে বলেছে, নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য বিদেশিরা চেষ্টা করছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত করতে চায় এবং সম্ভাব্য ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে হেয় করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে, চীন চায় বাইডেন বিজয়ী হোক, তবে চীনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ট্রাম্পের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রচার চালিয়েছে এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে—এ অভিযোগ নিয়ে একাধিক তদন্ত হয়েছে। ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলেও এটা প্রমাণিত হয়েছে যে রাশিয়া নির্বাচন প্রভাবিত করেছিল এবং এ জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।

করোনাভাইরাসের বিস্তার এবং গত কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতির কারণে নির্বাচনী প্রচারাভিযান এখনো জোরদার হয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার যে অসাংবিধানিক প্রস্তাব করেছিলেন, তা ডেমোক্রেটিক পার্টি, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং রিপাবলিকান পার্টিরও অনেক আইনপ্রণেতা খারিজ করে দিয়েছেন। এটা নিশ্চিত, ৩ নভেম্বর নির্বাচন হবে, কিন্তু এই নির্বাচন অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন হবে। করোনাভাইরাস মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে তিনটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

প্রথম চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে নির্বাচনী প্রচার চালানো। সাধারণত নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সূচনা হয় গ্রীষ্মকালে দলগুলোর বড় আকারের কনভেনশনের মাধ্যমে। এবার দুই দলই কনভেনশন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। মনোনয়নের আনুষ্ঠানিকতা কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো দলই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বড় ধরনের সমাবেশ, যা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খুব পছন্দের, সেটা সম্ভব হবে না; ২ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করে ওকলাহোমা রাজ্যের টালসা শহরে ২০ জুনের সমাবেশে লোক উপস্থিত করাতে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার দল ব্যর্থ হওয়ার পর এটা স্পষ্ট। এ ধরনের সমাবেশ জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। প্রচলিত সব ধরনের প্রচারাভিযান, বাড়ি বাড়ি যাওয়া কিংবা বাস নিয়ে সারা দেশ সফর কাজে দেবে না। সেই প্রেক্ষাপটে টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালের অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে মোটেই ইতিবাচক নয়।

এখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার পক্ষ থেকে অপপ্রচার চলছে এবং তা ভবিষ্যতে বাড়বে। গত বুধবার জো বাইডেনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তাঁর প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য ২২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে, সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য ৩০ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে এখন পর্যন্ত আর কোনো প্রার্থীর টেলিভিশনে এত ব্যয়ের ইতিহাস নেই। কেবল প্রচার চালানোই নয়, প্রার্থীদের বিশেষ করে জো বাইডেনকে বিভিন্ন ধরনের ফেক নিউজ এবং অপপ্রচার মোকাবিলা করতে হবে। ফলে ২০২০ সালের নির্বাচনের প্রচার কেবল প্রার্থীর প্রচারণা নয়, হয়ে উঠবে তথ্যের লড়াই।

ভোটারদের ভোট দেওয়া নিশ্চিত করাই হচ্ছে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য ডেমোক্র্যাটরা চাইছে ডাকযোগে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থাকে সর্বজনীন অর্থাৎ সবার বাড়িতে ব্যালট পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। এখন মাত্র পাঁচটি রাজ্যে এই ব্যবস্থা আছে সেগুলো হচ্ছে কলোরাডো, হাওয়াই, ওরেগন, ওয়াশিংটন ও ইউটা। তিনটি রাজ্যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর ওয়াশিংটন ডিসিসহ ৩০টি রাজ্যে যেকোনো ভোটার আবেদন করলে তাঁর কাছে ডাকযোগে ব্যালট পাঠানো হয়। অন্য কিছু রাজ্যে এ জন্য গ্রহণযোগ্য কারণ দেখাতে হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ডাকযোগে ভোটে জালিয়াতি হয় বলে মিথ্যা অভিযোগ করে প্রচার চালাচ্ছেন। তারপরও সম্প্রতি ট্রাম্প পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন লুই ডিজয়কে, তিনি ২০১৬ সালের ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে বড় আকারের চাঁদা দিয়েছিলেন। লুই ডিজয় পোস্টাল বিভাগে এমন কিছু পরিবর্তন করেছেন, যাতে ডাক সংগ্রহ এবং পৌঁছানো বিলম্বিত হবে। এগুলো ডাকযোগে ভোট কমানো এবং বিলম্বিত করার চেষ্টা বলে অনেকেই মনে করেন, ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতারা এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কতটা সফল হবেন, সেটাই প্রশ্ন।

নির্বাচনের তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশ করা। হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে সাধারণত নির্বাচনের দিবাগত রাতেই ফলাফল জানা যায়। ২০১৬ সালে ১৩৮ মিলিয়ন নাগরিক ভোট দিয়েছিলেন, এর এক–চতুর্থাংশ ভোট এসেছিল ডাকযোগে। এই বছর ভোটার এবং ডাকযোগে ভোট বাড়বে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। এই ভোট গণনা কত দ্রুত করা যাবে, সেটা একটি প্রশ্ন। বড় রকমের ব্যবধানে পরাজিত না হলে ট্রাম্প এ নিয়ে আপত্তি তুলে আদালতে যেতে পারেন বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই রকম পরিস্থিতি হলে ২০০০ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ২০০০ সালে ফ্লোরিডার ভোট গণনা নিয়ে আইনি লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের ৫-৪ রায়ের ফলে রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ বুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই রায় এসেছিল ১২ ডিসেম্বর, নির্বাচনের পাঁচ সপ্তাহ পরে।

আগামী কয়েক সপ্তাহ এসব চ্যালেঞ্জের দিকেই সবার মনোযোগ থাকবে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।