অনলাইনের জীবনেও যেন মানবিকতা থাকে

অনলাইনে পড়ালেখার সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি
ছবি: খালেদ সরকার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশে এখন সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিকভাবে চলছে। জীবন ও জীবিকার যুদ্ধে মহামারির ভয়কে তুচ্ছ করেই মানুষ আজ ‘নতুন স্বাভাবিক’ জীবনে অভ্যস্ত। গত বছর ১৭ মার্চ থেকে স্কুলগুলো ছুটি হলেও এই ছুটিকে ঠিক ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’ বলা যাচ্ছে না। এ যেন ঘরে বদ্ধ থেকে জগৎটাকে অনলাইনে দেখার প্রয়াস। তাই বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, কিন্তু শিক্ষা আদান-প্রদান নয়।

আগেও যে আমরা ক্লাসরুমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিইনি তা নয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সেটিকে একেবারেই মেলানো যাবে না। বাড়িতে বসে শিক্ষার্থীদের বাস্তবে না দেখেও ভার্চ্যুয়ালি দেখা আর শোনা—শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের কাছাকাছি থাকার এক নিরন্তর প্রচেষ্টা। আগে যেখানে মা-বাবারা ওদের ফোন বা ল্যাপটপ ধরতে নিষেধ করতেন বা দিলেও তা ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ ছিল; আজ সেই অভিভাবকেরাই পড়ালেখার জন্য স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ তুলে দিচ্ছেন প্রিয় সন্তানের হাতে। অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া এখন আর নতুন কিছু নয়। পিডিএফ ফাইল তৈরি করা, ডক ফাইল, ডেটা আপলোড—সবই শিক্ষার্থীদের পরিচিত। আজকের এই খুদে প্রাণগুলো সময়ের তাগিদে, জীবনের প্রয়োজনে ডিজিটাল মাধ্যমেও দারুণ তুখোড়।

শুধু কি নতুন প্রজন্ম? আমরা শিক্ষকেরাও এই নতুন প্রয়াসের সক্রিয় অংশীদার। শিক্ষকেরা স্লাইড আর ভিডিও দেখিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন নিয়মিত। অনেকে ব্যবহার করছেন ‘ইন্টারঅ্যাকটিভ বোর্ড’। কেউ কেউ আরও উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন। শিক্ষার্থীদের হাজিরা নেওয়া থেকে শুরু করে ক্লাস লেকচার আপলোড—সবকিছুই এখন ডিজিটাল শিক্ষার অংশ। এখন যুগ শেয়ারের, লাইকের, ভাইরালের আর ট্রলের। তাই নতুন ডিজিটাল ক্লাসরুম—ভিউ, শেয়ার, ফলোয়ার আর কমেন্টনির্ভর। গতানুগতিক, প্রাচীন, সনাতনী ধারায় যেসব শিক্ষক পড়াতেন, তাঁরাও আজ সময়ের দাবিতে প্রযুক্তিকে আয়ত্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্কুল বন্ধের ১০ মাস পরও তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন বিচ্ছিন্ন নয়। মেইল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ভাইবার, ইমো, জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ডিসকর্ড—এমন নানা মাধ্যমে তারা সংযুক্ত একে অপরের সঙ্গে।

এ অনলাইন ক্লাস শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানা নতুন ঘটনা আর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করছে। যান্ত্রিক শিক্ষার মধ্যেও যন্ত্রের মধ্যেই মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে শিক্ষার্থীদের অযান্ত্রিক মজার কর্মকাণ্ড। পড়া না শিখলে নেট চলে যাওয়া, মাইক্রোফোনে সমস্যা হওয়া, চ্যাট বক্সে গল্পের আসর বসানো, ক্লাসে সাইন-ইন করে ঘুমানো বা গেম খেলা...এসব তো রোজকার ঘটনা। আবার বাড়ি থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে ক্লাস করার কারণে দুজনের বাড়ির নিত্যদিনের অবস্থা আর ক্লাস চলাকালে ঘটে যাওয়া মজার ঘটনাগুলোও নতুন নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্লাস করেন তাদের ভাই-বোন, কখনো মায়েরা, বাবারা। বাসাটাই যখন স্কুল, সবাইকে তো শিক্ষার্থী হতেই হয়!

তবু নতুন এই বাস্তবতায়, নতুন রুটিনের সঙ্গে শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর অভিভাবকেরা মানিয়ে নিচ্ছেন সুন্দরভাবেই। ঘরে বসেও তাঁরা অনেকেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন সৃজনশীল কাজে। কেউ ছবি আঁকা, গান করা, গিটার বাজানো, লেখালেখি করা, এমনকি অলংকরণ, ভিডিও সম্পাদনা, অ্যানিমেশন, ইউটিউবে নিজেদের ভিডিও আপলোড করা...কত কিছু করছে রোজ।

সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়ার পরও শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মা-বাবা—সবার এই দীর্ঘ ঘরবন্দী সময়ে আর মন টিকছে না। ছোটাছুটি, খেলাধুলা না করে শিশু-কিশোরদের ব্যস্ত রাখার যে আয়োজন—তা বেশ স্মার্ট, যুগোপযোগী হওয়ার পরও ঠিক পূর্ণতা পায় না। এখন প্রায়ই ওরা বলে, ‘আর ভালো লাগছে না, আর কত দিন?’ এখন স্কুল বাসায়, তবু কী যেন একটা নেই। ছুটির ঘণ্টা বাজলে ওদের সমস্বরের চিত্কার দেওয়া হয় না, দৌড়ানো হয় না। টিফিন পিরিয়ডে ক্যানটিনে হুড়োহুড়ি করে শিঙাড়া আর ঝালমুড়ি খায় না ওরা। কত দিন ওরা মাঠে দৌড়ে খেলে না! বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডায় মেতে ওঠে না! ক্লাসে সামনে বসে শিক্ষকের পড়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে না। স্মার্টফোন হাতের নাগালে পাওয়ার পরও তৃপ্ত নয় ওরা। বড্ড মিস করে স্কুলের মাঠ, ক্লাসরুম, রোজকার রুটিন, আড্ডা, খেলা, বকা, পরীক্ষা, সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম—সবকিছুই।

জানি না এমনটা আর কত দিন চলবে। কিন্তু এ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সবার যে আপ্রাণ চেষ্টা—তার যেন জয় হয়। অনলাইন জীবনটা যেন মানবিকতাকে হারিয়ে না দেয়। এই খুদে প্রাণগুলো তাদের শৈশব আর কৈশোরে যে বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করল, তা যেন ওদের ভবিষ্যৎ জীবনে ধৈর্য, পরিমিতিবোধ, সহমর্মিতা আর নিঃস্বার্থ হতে শেখায়। না হয় এখন একটু পড়ার বই না পড়ে গল্পের বই নিয়ে থাকল বেশি, করল কিছু সৃজনশীল কাজ। অনলাইন পরীক্ষায়, অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর কমই পেল। পাঠ্যপুস্তকের পড়া একটু কম শিখল, না–ই হলো এবার প্রথম, দ্বিতীয়। প্রতিযোগিতা, সেই চিরচেনা ব্যস্ত জীবনযাপনের অপেক্ষা না হয় থাক আরও কিছুদিন। তবু সুস্থ ও নিরাপদ থাকুক আমাদের সন্তানেরা। যান্ত্রিক হয়ে যাওয়া জীবনে ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দটা বেঁচে থাকুক। সীমিত পরিসরের শিক্ষা, নতুন স্বাভাবিকতা আমাদের অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়ার অসীম শক্তি আর অনুপ্রেরণা দিক।

লেখক: শিক্ষক, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়