এই বুঝি দেশ থেকে কোনো দুঃসংবাদ এল

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা করেছিলেন মানববন্ধন
ছবি: সংগৃহীত

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাইতামের সঙ্গে প্রথমবার আলাপ হয়েছিল বছর দুই আগে। তখনো ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলা-হত্যাযজ্ঞ চলছিল। তবে হাইতাম তখন আশা নিয়ে বলেছিলেন, এমবিবিএস করে যখন তিনি ফিলিস্তিনে ফিরে যাবেন, তত দিনে হয়তো তাঁর দেশে শান্তি ফিরে আসবে। যুদ্ধাহত কোনো ব্যক্তিকে তাঁর চিকিৎসা দিতে হবে না। সময়ের ব্যবধানে হাইতাম এখন ইন্টার্ন চিকিৎসক। এমবিবিএসের দ্বারপ্রান্তে এলেও হাইতামের দেশে যুদ্ধ থামেনি, বরং দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি।

ফোনের ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আধো বাংলায় হাইতাম বললেন, ‘আমার পরিবারের সবাই এখনো বেঁচে আছে, এটাই হয়তো সান্ত্বনা। তবে ভবিষ্যতে কী হবে, জানি না। গাজায় আমার পরিচিত অনেকে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ মারাও গেছেন। ফিলিস্তিনে এটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সেখানে জীবনের দাম নেই। এখন সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।’

হাইতামের মতো প্রতিবছরই ফিলিস্তিন থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের বেশির ভাগই ভর্তি হন মেডিকেলে। গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর থেকে পরিবারের জন্য বেশ দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন এই শিক্ষার্থীরা।

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী বদর সামির আবুলাইলার বাড়ি ফিলিস্তিনের গাজায়। তাঁর বোন শাদা সামির আবুলাইলাও একই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। দুই ভাই–বোন একসঙ্গে থাকলেও গাজায় পড়ে আছে তাঁদের মন। বদর বলেন, ‘সব সময়ই পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। গাজায় এখন ইন্টারনেট নেই। বিদ্যুৎও নেই। দুই দিন ধরে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। কিছুদিন পরই আমাদের পরীক্ষা। কিন্তু কোনোভাবেই এখন পড়াশোনায় মন বসাতে পারছি না। একটু পরপরই আমার বোন কাঁদছে। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো শক্তি আমার আর নেই।’

দুঃসংবাদ যেন নিত্যসঙ্গী

বদরের সহপাঠী তালাল আল নাদির বাড়ি ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাংকে। বদরের সঙ্গে একই ছাত্রাবাসে থাকেন তিনি। তালাল জানালেন, ওয়েস্ট ব্যাংকের অবস্থা গাজার মতো শোচনীয় না, তবে সেখানেও শতাধিক প্রাণহানি হয়েছে। অনেকেই বাড়ি ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। মুঠোফোন হাতে নিলেই কোনো না কোনো করুণ দৃশ্য চোখের সামনে পড়ছে। তাই তিনি ফোন থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।

তালাল তাঁর আরেক বন্ধু ইব্রাহিম কিস্কোর মুঠোফোন নম্বর দিলেন। ইব্রাহিম ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। তাঁর পরিবারের সবাই গাজার বাসিন্দা। ইব্রাহিমের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে দুই দিন যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। প্রথম দিন ফিরতি বার্তায় জানালেন, তাঁর বাড়ির এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। পরিবারের অবস্থা ভালো নয়। পরদিন খোঁজ নেওয়ার জন্য ইব্রাহিমকে আবার কল দেওয়া হলে তিনি কেটে দেন। পরে খুদে বার্তায় জানান, বোমা হামলায় তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য মারা গেছেন। মানসিকভাবে তিনি বেশ ভেঙে পড়েছেন। এ অবস্থায় ইব্রাহিমের সঙ্গে আর কথা বলা গেল না।

পরিবারের এমন দুঃসময়ে তাঁদের পাশে থাকতে পারলে হয়তো স্বস্তি পেতেন এই তরুণেরা। তবে চাইলেও দেশে ফেরার উপায় নেই। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার্থে আসা ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের সংগঠন জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টিনিয়ান স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশের সহসভাপতি বাদাওই আহমেদ জানালেন, অন্যান্য সময়ও তাঁরা ইচ্ছেমতো নিজ দেশে যেতে পারেন না। কারণ, যেকোনো সময় তাঁদের দেশে সংঘাতের আশঙ্কা থাকে। অনেক সীমান্ত ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। যেকোনো ধরনের সংঘাত বা বিশৃঙ্খলা শুরু হলে দেশে আটকে পড়ার ঝুঁকি থাকে। একবার আটকা পড়লে পড়াশোনায় পিছিয়ে যেতে হয়। এখন যেমন তাঁদের সংগঠনের সভাপতিসহ তিন শিক্ষার্থী বর্তমানে ফিলিস্তিনে আটকা পড়েছেন।

সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ফিলিস্তিনের প্রায় ৯০ জন শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ছেন। যাঁরা এ দেশে সবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছেন, তাঁদের জন্য এই দুঃসময় পাড়ি দেওয়া আরও কঠিন।

মাত্র দুই মাস আগে বাংলাদেশে এসেছেন ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আহমেদ আবুদায়া। আহমেদ বলেন, ‘পরিবার ছেড়ে এত দূরে আগে কখনো থাকিনি। পাঁচ দিন আগে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। এর পর থেকে আর যোগাযোগ করতে পারছি না। একে তো বাড়ি ছেড়ে আরেক দেশে এসেছি। এর মধ্যে আবার সারা দিন আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে, এই বুঝি দেশ থেকে কোনো দুঃসংবাদ এল! সব মিলিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।’

পাশে আছেন বাংলাদেশের বন্ধুরা

ফিলিস্তিনি বন্ধুদের দুঃসময়ে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের সহপাঠী, শিক্ষকসহ স্থানীয় বাসিন্দারা। সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজের বদর বলেন, ‘এখানকার বন্ধুরা প্রতিদিন তো পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছেই, এমনকি হলের খালা-মামাদের সঙ্গে দেখা হলেও তাঁরা আমাদের বাড়ির লোকজনের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন। আমরা এখানে শাহজাহান নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির মাঠে ফুটবল খেলতে যাই। গত কয়েক দিনে শাহজাহান ভাইও প্রায় প্রতিদিনই আমার পরিবারের খোঁজ নিতে আমাকে কল দিচ্ছেন।’

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে ইতিমধ্যে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা ও ফরিদপুরে অবস্থানরত ফিলিস্তিনের শিক্ষার্থীরা। বাদাওই আহমেদ জানালেন, বাংলাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও তাঁদের সঙ্গে এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এমন সমর্থনের জন্য তিনি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন