‘সাদুর বউ’ হতে ৬ মাস শ্যাম্পু করেননি, সেকেন্ড হ্যান্ড জামা পরেছেন নাজিফা তুষি

অভিনেত্রী নাজিফা তুষি
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘তোর নাম কী রে?’

‘আমার নাম? সাদুর বউ।’

মেজবাউর রহমান সুমনের ‘রইদ’ চলচ্চিত্রের ট্রেলার প্রকাশের পর থেকেই আলোচনায় আছে নাজিফা তুষির লুক। হোয়াটসঅ্যাপে তুষি থেকে ‘সাদুর বউ’ হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন তিনি।  

‘হাওয়া’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়ই নাজিফা তুষি শুনেছিলেন রইদের গল্প। তিনি যখন আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের সিনেমার শুটিংয়ের শেষ দিকে, তখন তাঁকে ‘রইদ’–এ ‘সাদুর বউ’ চরিত্রটির প্রস্তাব দেওয়া হয়।

তুষি বললেন, ‘এ রকম চরিত্র করার সুযোগ শিল্পীর জীবনে খুব বেশি আসে না। আমি এমনিতেই বেছে বেছে খুবই কম কাজ করি। আর একটা কাজ করার সময় কেবল সেই জার্নিতেই ডুবে যাই। তারপর নিজের চরিত্রে ফিরে আসতেও সময় লাগে।’

২০২৩ সাল থেকে তুষি ‘সাদুর বউ’ চরিত্রের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। চরিত্রটি খানিকটা বিকারগ্রস্ত, রহস্যময়। তাই এই অভিনেত্রী ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মানসিক আরোগ্য পরিষেবা (ডিএমএইচ) ও পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেছেন।

একাধিক মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। ডিমেনশিয়ার বিভিন্ন স্তরে রোগীর কী হয়, তাঁরা কেমন আচরণ করেন—এসবই ছিল তুষির জিজ্ঞাসা। কেননা ‘সাদুর বউ’ চরিত্রটিরও ডিমেনশিয়া আছে।

তুষি বলেন, ‘আমি রাতেও থাকতে চেয়েছিলাম। তবে নিরাপত্তার কারণে আমাকে রাতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাই সারা দিন ওদের সঙ্গে থাকতাম। ওদের একটু প্রায়োরিটি দিলে, মনোযোগ দিলে ওরা আহ্লাদিত হয়ে যায়। ওরা হাসে, নাচে, খেলে, আদর করে, মারতে আসে। সোমা, তন্বী—এদের সঙ্গে তো আমার রীতিমতো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।’

আরও পড়ুন
‘রইদ’ সিনেমার ট্রেলারে এভাবেই দেখা গেছে তুষিকে
ছবি: ভিডিও থেকে

পাবনা মানসিক হাসপাতাল কেমন দেখলেন? তুষি বললেন, ‘ওটা এক্সট্রিম। ওখানে সাধারণত দুই ধরনের রোগীদের দেখা যায়। হয় একেবারে চুপচাপ বা নিস্তেজ হয়ে গেছে। অথবা খুবই হাইপার হয়ে আছে। সাধারণত ওষুধের প্রভাবে এ রকম হয়।’

তুষি জানান, তিনি যত মানসিক ভারসাম্যহীন নারী দেখেছেন, তাঁরা সবাই একসময় সুস্থ ছিলেন। বিয়ের পর বা সন্তান হওয়ার পর মানসিক চাপ বা শকে তাঁরা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। কেননা তাঁরা এমন সব বাস্তবতা দেখেছেন, সেগুলো দেখার পর মেনে নিয়ে আর সুস্থ থাকা যায় না। তাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়া বা ডিমেনশিয়ায় ভোগা তাঁদের জন্য একধরনের ‘ডিফেন্স মেকানিজম’। যাতে তাঁরা কষ্টটা ভুলতে পারেন।

নাজিফা তুষির জন্ম চট্টগ্রামে হলেও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। পুরোদস্তুর শহুরে এই নারীর ‘সাদুর বউ’ হয়ে ওঠার যাত্রা সহজ ছিল না। তিনি জানালেন, তাঁদের শুটিং হয়েছে সিলেটের সাদাপাথর এলাকার পেছনে, শাহ আরেফিন টিলার কাছে, সীমান্ত এলাকায়। শুরুতে সেটি কেবলই চর ছিল। প্রায় সাত মাস ধরে অন্যদের সঙ্গে তুষিও সেটের বাড়িটি বানিয়েছেন, মাটি ফেলেছেন, লেপেছেন, গাছ লাগিয়েছেন।

তুষি বললেন, ‘আমি মাসের পর মাস রোদে পুড়েছি। আমাদের সে রকম প্রসথেটিকস বিশেষজ্ঞ নেই। আবার অতিরিক্ত মেকআপে অভিনয়ের সহজ, স্বাভাবিক বিষয়টাও থাকে না। তাই সবচেয়ে সহজ হলো চরিত্রটার মতো হয়ে যাওয়া।

‘ওখানকার নারীরা সাধারণত দিনমজুরের কাজ করেন। তাঁদের শরীর দেখলেই বোঝা যায়। আমিও প্রচুর পরিশ্রম করে শরীরে ওই ব্যাপারটা এনেছি। সেকেন্ড হ্যান্ড জামাকাপড় কিনতাম। নিজেই আবার সেগুলো পরিষ্কার করে পরতাম। শুটিংয়ের আগে ও শুটিংয়ের পুরোটা সময় আমি নিজের কোনো পোশাকই পরিনি।

‘মাস ছয়েক তো মাথায় শ্যাম্পুই দিইনি। বিশ্বাস করবেন কি না, আমার কোনো আলাদা মেকআপ ছিল না। রোদে পোড়া চেহারা, চুল, ধুলাময়লা, কালি, বালুমাখা, শর্ষের তেল মেখে ট্যান হওয়া, পান খেয়ে দাঁতে টেক্সচার আনা—এগুলোই।’

তুষি বলছেন, সিনেমার জন্য আলাদা কোনো মেকআপ নেননি
ছবি: ভিডিও থেকে

তুষি জানান, কেবল তিনিই যে অনেক কষ্ট করেছেন, তা নয়, সেটের প্রত্যেকটা মানুষ তাঁদের সেরাটা ঢেলে দিয়েছেন। স্থানীয় আলামিন, মোস্তফা, নজরুল, আফসারাদের বাসায় থেকেছেন, খেয়েছেন তুষি। সিনেমার সেট তৈরি, গাছ লাগানো, রান্না করা, অভিনয়—সব এঁরাই করেছেন।

এমনকি শুটিং শেষে তাঁরা ঢাকায় এসে তুষিদের সঙ্গে দেখাও করে গেছেন। তুষি বললেন, ‘এটাই আমাদের পরিচালকের (মেজবাউর রহমান সুমন) কাজের প্রক্রিয়া। এর আগে যখন সাগরে কাজ করেছেন, স্থানীয়দের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে গিয়ে কাজটা বের করে এনেছেন। না হলে ওই এলাকা, এলাকার মানুষ, স্থানীয় ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজটা বের করে আনা সম্ভব নয়। ক্যামেরায় সেই সত্যির অভাব, মেকি ভাব বা অসততা ধরা পড়ে যায়।’

তুষি আরও জানান, সাদু চরিত্রে অভিনয় করা মোস্তাফিজ নূর ইমরানও তাঁর চরিত্রের জন্য ভীষণ খেটেছেন। তিনি বললেন, ‘একেকজনের একেক চরিত্র, তাই তাঁদের চরিত্র হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাও ভিন্ন। ইমরান ভাই যেমন নৌকা চালানো শিখেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ছিপ ফেলে চুপচাপ মাছ ধরতেন। ছিপ ফেলে মাছ ধরা যে একটা মেডিটেশন, আর এটা যে কী পরিমাণ থেরাপিউটিক, এটা আমি সেটে তাঁকে দেখে শিখেছি।’

নাজিফা তুষি এখন আবার ‘নিজের’ চরিত্রে ফিরেছেন
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম, সেটের এখন কী অবস্থা, গাছগুলো কেমন আছে? তুষি বললেন, ‘প্রথমে মাটি ফেলা হলো, বীজতলা বানানো হলো। বীজ ফেলা হলো। দেখা গেল, ওই মাটিতে গাছ হচ্ছে না। আবার নতুন করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে মাটি ফেলা হলো। নতুন বীজ দেওয়া হলো। বাড়ি বানানো হলো। বাড়ি পোড়ানো হলো।

কোনোরকমে শুটিং পর্যন্তই সেটটা রাখা গেছে। শুটিং শেষ, ইচ্ছেমতো গাছ কেটে, টিলার পাথর, ঘরের প্রতিটা ইট খুলে নিয়ে গেছে। এখন আর কিচ্ছু নেই।’
২০২৬ সালে মুক্তি পেতে পারে মেজবাউর রহমান সুমনের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘রইদ’।

আরও পড়ুন