চার ভাইবোনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সংগ্রাম

বাঁ থেকে মনিরা খাতুন, মো. ফিরোজুর রহমান, মো. আমানুল্লাহ ও মো. হুজ্জাতুল্লাহ। হুজ্জাতুল্লাহ এবার সমাবর্তন পাননি; বড় ভাই–বোনদের সঙ্গে গাউন পরে দাঁড়িয়ে গেছেন তিনিছবি: মো. ফিরোজুর রহমানের সৌজন্যে

সেদিন ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বাদশ সমাবর্তন। ১৭ ডিসেম্বর। গাউন আর হ্যাট পরা হাজারো শিক্ষার্থীর ভিড়ে এক পরিবারের চার ভাইবোনকে একটু আলাদাই লাগল। তাঁরা হলেন পুঠিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত ধোপাপাড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হারুন-অর রশিদের চার সন্তান—মো. আমানুল্লাহ (উর্দু বিভাগ), মো. ফিরোজুর রহমান (ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ), মনিরা খাতুন (উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ) ও মো. হুজ্জাতুল্লাহ (চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগ)। দারিদ্র্য আর সংগ্রামের পাহাড় ডিঙিয়ে একই ক্যাম্পাস থেকে তাঁদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের গল্পটা অনুপ্রেরণার বটে।

২০০৫ সালে যখন চার ভাইবোনের মধ্যে বড়—আমানুল্লাহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন বাবা মো. হারুন-অর রশিদের বেতন ছিল মাত্র ৩ হাজার ১০০ টাকা। এ সামান্য আয়ে চার সন্তানের পড়াশোনা চালানো ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছিল অভাব।

আরও পড়ুন

ফিরোজুর রহমান জানান, বাবার সঙ্গে দুই ভাইকেও হাড়ভাঙা খাটুনি করতে হতো। খেজুরগাছ কাটা, রস থেকে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি, ধান কাটা ও মাড়াই, এমন কোনো কাজ নেই, যা তাঁরা করেননি। আর্থিক সংকটে দুই ভাই একসঙ্গে মেস বা হলে থাকার ‘বিলাসিতা’ করতে পারেননি।

একজন যখন হলে থাকতেন, অন্যজনকে বাড়ি থেকে যাতায়াত করে ক্লাস করতে হতো। কখনো কখনো ছোট ভাইবোনের পড়ার খরচ মেটাতে বড় ভাইকে বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজের শিক্ষাসফর কিংবা পিকনিকের আনন্দ।

ফিরোজুর রহমান বলেন, ‘অনেক সময় বাবা বলতেন, তোমার পিকনিকে না গেলে কি খুব অসুবিধা হবে? তখন আমরা বুঝতাম, বাবা কোনোভাবেই এই খরচটি আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আমরাও মানিয়ে নিতাম।’

ধোপাপাড়া মোহনপুর আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম শেষ করে চার ভাইবোনই একে একে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বড় ভাই যখন অনার্স-মাস্টার্স শেষে পিএইচডি শুরু করেন, সেই ছায়া অনুসরণ করে মেজ ভাই ফিরোজুর রহমানও পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

আরও পড়ুন

বর্তমানে ছোট বোন মনিরা ও ছোট ভাই হুজ্জাতুল্লাহও একই পথে হাঁটছেন। তাঁরা একে অপরের অভিভাবক, বন্ধু, সহযোদ্ধা। এমনকি পরিবারের নতুন সদস্যরাও (ছোট বোনের স্বামী ও ফিরোজুর রহমানের স্ত্রী) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই অ্যালামনাই, বর্তমানে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে কর্মরত।

ফিরোজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের আজকের এই অবস্থানের পেছনে ,মা-বাবার কষ্টটাই সবচেয়ে বেশি। তবে আমাদের মধ্যেও সেই বোঝাপড়াটা ছিল। সেটাই আদতে সহযোগিতা করেছে।’

ফিরোজুর রহমানদের ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’ মনে করিয়ে দিয়েছে সমাবর্তনের এই দিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বাদশ সমাবর্তনের দিনটি ছিল এক স্বপ্নের পূর্ণতা। তিন ভাইবোন একসঙ্গে নাম নিবন্ধন করেছেন, একই রঙের গাউন পরে হ্যাট উঁচিয়ে ছবি তুলেছেন। বড় দুই ভাইয়ের পিএইচডি আর ছোট বোনের মাস্টার্স ডিগ্রির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার মুহূর্তটি ছিল দীর্ঘ ২০ বছরের সংগ্রামের ফসল।

ফিরোজুর রহমান বলেন, ‘অনার্স–মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডির সিদ্ধান্ত যখন নিই, তখন প্রতিনিয়তই শুনতে হতো—পিএইচডি করে কী হবে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গবেষণায় আসা খুব কঠিন। কিন্তু আমরা সেই চ্যালেঞ্জটাও নিয়েছিলাম। তাই আজকের সমাবর্তনের ছবিগুলো অনেক গর্বের, যেখানে মিশে আছে মা-বাবার রক্ত নিংড়ানো শ্রমের গল্প।’

আরও পড়ুন