যেভাবে হাতে হাতে পৌঁছে গেল রিদ্মিক কি-বোর্ড
সমাজ ও দেশের নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখা তরুণদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ ‘স্টারশিপ ইন্সপায়ারিং টেন’। গত সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো ১০ তরুণকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। ‘সফটওয়্যার প্রযুক্তি’ শাখায় সম্মাননাটি পেয়েছেন রিদ্মিক কি-বোর্ডের উদ্ভাবক মো. শামীম হাসনাত। তিনি লিখেছেন রিদ্মিক কি-বোর্ডের যাত্রার গল্প।
২০১২ সাল। ঈদুল ফিতরের ছুটি চলছে। তখন আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছুটিতে হাতে অনেক সময়, কিন্তু করার কিছু নেই। কম্পিউটারের সামনে বসে পর্দায় চোখ রেখে মনে হলো, এভাবে সময় নষ্ট না করে নতুন কিছু শেখা দরকার।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে জাভা প্রোগ্রামিং শেখানো হচ্ছিল। অনুশীলন শুরু করলাম। প্রতিদিন কম্পিউটার খুলে কোড লিখতাম, ছোট ছোট প্রোগ্রাম, অন্য ভাষায় করা কোড আবার জাভায় করা ইত্যাদি।
একদিন ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে একটি ওয়েবসাইট চোখে পড়ল। সেখানে যেকোনো ভাষার শব্দ টাইপ করলে ইউনিকোড, কোডপয়েন্ট, অন্যান্য ফরম্যাটসহ নানা আকারে দেখা যায়। এসব আমার কাছে একেবারেই নতুন। আগে ভাবতাম, বর্ণ মানে শুধুই বর্ণ। কিন্তু ওয়েবসাইটটি ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝতে পারলাম, প্রতিটি বর্ণের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি কোড, একটি সংখ্যা।
প্রথমবার উপলব্ধি করলাম, ভাষা আর প্রযুক্তি একে অপর থেকে আলাদা নয়। যেখানে একটি বর্ণও কোডে রূপান্তরিত হয়, তারপর ফন্টের মাধ্যমে আবার চোখের সামনে ফিরে আসে।
সেখান থেকেই শুরু হলো ফোনেটিক কনভার্শনের জন্য কোড লেখা। বিষয়টা হলো কেউ যদি ইংরেজিতে ‘ami’ লেখেন, সেটা বাংলায় ‘আমি’ হয়ে যায়। প্রথম দিকে খুব সহজ কোড হলেও এরপর আসে যুক্তবর্ণ, রেফ, তিন বর্ণের যুক্তবর্ণ, র-এর সঙ্গে য-ফলা লেখার বিশেষ পদ্ধতি ছিল বেশ জটিল।
কখনো এক অক্ষর ঠিকভাবে পরিবর্তন হচ্ছিল না, কখনো পুরো শব্দ উল্টো দেখাচ্ছিল। কিন্তু প্রতিটি সমস্যার সমাধান মানে ছিল নতুন শেখা। ছোট ছোট সেই সাফল্যই আমাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে গেছে।
অ্যান্ড্রয়েডে নিজের কি-বোর্ড
২০১২ সালে হঠাৎ একদিন মনে হলো, এটি দিয়ে তো একটি অ্যান্ড্রয়েড কি-বোর্ড তৈরি করা যায়। তখন স্মার্টফোন সবে জনপ্রিয় হচ্ছে। মাসখানেক হয় আমিও ব্যবহার করছি। তাই অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপমেন্টের অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে কয়েক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে সেমিনার হয়েছিল। সেই ভিডিও ছুটির আগে ডাউনলোড করে রেখেছিলাম। ভিডিও দেখেই অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপমেন্টের জন্য ‘কোড এডিটর’ সেটআপ করে নিই।
এভাবেই শুরু হয় আমার কি-বোর্ড তৈরির কাজ। শুরুতে নিজে ব্যবহার করার জন্যই তৈরি করছিলাম। এ কারণে শুধু ফোনেটিক ইনপুট ছিল। পরে ভাবলাম, গুছিয়ে নিলে প্লে স্টোরে প্রকাশ করা যাবে। সবাই ফোনেটিকে অভ্যস্ত নয়, তাই ইউনিজয় ও একই জাতীয় লে–আউট যোগ করে দিলাম।
একাধিক লে–আউট থাকায় তা বদলানোর জন্য একটা বাটন দরকার হলো। স্পেস বাটনের প্রতিসাম্য রক্ষা করতে স্পেস বাটনে ‘সোয়াইপ’ করে ভাষা পরিবর্তনের পদ্ধতি আনলাম। পরে ইমোজির জন্যও বাটন দরকার হলো, আবার প্রতিসাম্য রক্ষা করতে স্পেস বাটনে দীর্ঘ চাপ দিলে ইমোজি দেখাবে, এমন পদ্ধতি ব্যবহার করলাম। এভাবেই তৈরি হলো অ্যান্ড্রয়েড কি-বোর্ড।
কোটি মানুষের হাতে যেভাবে গেল
কি-বোর্ড তৈরি হওয়ার পর মনে হলো, এটা কি সত্যিই প্রকাশ করার মতো কিছু হয়েছে? নিজের জন্য করা, তাই প্রকাশে দ্বিধা ছিল অনেক। এরপরও অনেকেই সেটি প্লে স্টোরে প্রকাশে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
কিন্তু প্লে স্টোরে প্রকাশের জন্য তো একটা নাম আর লোগো দরকার। বন্ধুদের দেওয়া নামগুলো পছন্দ করতে পারছিলাম না। তখন আরেক বন্ধু নাহিয়ান ইসলাম মেসেজ করে ‘Ridmik’ নামটি প্রস্তাব করে। সে সম্ভবত ‘rhythmic’ (রিদমিক) শব্দটাকে সংক্ষিপ্ত করে ‘Ridmik’ লিখেছিল। তবে এই রূপান্তরিত (মেটাপ্লাজম) শব্দ আমার বেশ পছন্দ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশের হলে থাকা স্কুলবন্ধু নাঈম ইসলাম লোগো তৈরি করে দিল। এরপর ২০১৪ সালে কপিরাইট সমস্যার কারণে অ্যাপটিকে আবার নতুন করে প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়। তখন লোগোর মূল ফাইল হারিয়ে যাওয়ায় নাঈম আবার নতুন লোগো তৈরি করে দেয়। পরে নতুন লোগো ও নাম দিয়ে কি-বোর্ডটি প্লে স্টোরে প্রকাশ করা হয়। এভাবেই শুরু হয় রিদ্মিক কি-বোর্ডের যাত্রা।
রিদ্মিক কি-বোর্ড কোনো ‘বড় প্রকল্প’ নয়। এটি ছিল এক তরুণ, মানে আমার শেখার গল্প মাত্র। সেটাই আজ কোটি মানুষের দৈনন্দিন যোগাযোগের অংশ হয়ে গেছে। সেই অলস দুপুরে যদি না ভাবতাম ‘কিছু একটা শেখা দরকার’, তাহলে হয়তো এই গল্পটার জন্ম হতো না।
প্রযুক্তি শুধু সুবিধা নয়
ইন্টারনেটের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৭-০৮ সালে, মুঠোফোনের ছোট স্ক্রিন দিয়ে। তখন দেখেছি, দেশের তরুণেরা টু-জি ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজ হাতে মুঠোফোন সাইট বানাচ্ছে—রিংটোন, ওয়ালপেপার, ছোট ছোট গেম শেয়ার করার জন্য। কেউ আবার মুঠোফোনে অনলাইন ফোরামও চালাচ্ছিল। এসব আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আজকের প্রজন্ম আরও এগিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ফাঁকেই তাঁরা স্টার্টআপ, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, অ্যাপ ও গেম তৈরি করছেন, কোম্পানি পর্যন্ত খুলছেন।
সঠিকভাবে ব্যবহৃত প্রযুক্তি পারে বৈষম্যের দেয়াল ভাঙতে, সবাইকে একই সুযোগের পরিসরে আনতে। একসময় যে সুযোগ ছিল কেবল শহরের বা বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের মানুষের জন্য, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের কল্যাণে আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে সেই সুযোগ।
আজ ইউটিউবে যে কেউ পেতে পারে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, প্রোগ্রামিং শেখার টিউটোরিয়াল কিংবা ডিজাইন শেখার ভিডিও। একসময় যেসব বিষয় শেখা ছিল ব্যয়বহুল বা অপ্রাপ্য, এখন সেসব এক ক্লিক দূরত্বে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
রিদ্মিক ল্যাবস থেকে ২০২০ সালে আমরা নিজের লেখা বই প্রকাশ ও পড়ার জন্য ‘বইটই’ নামে একটি অ্যাপ চালু করেছি। টিকটক, রিলস বা ছোট ভিডিওর জোয়ারেও ঢাকার বাইরের নতুন–পুরোনো অনেক লেখক-লেখিকা বই প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। অনেকেই মুঠোফোনেই বই লিখে ঢাকার মাঝারি থেকে বড় চাকরির সমপরিমাণ আয় করছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাঠকেরাও সহজে বই পড়তে পারছেন। সঠিকভাবে ব্যবহার করা প্রযুক্তি যে বৈষম্য কমাতে, সবাইকে সমান সুযোগ দিতে এবং প্রতিভা প্রকাশের পথ খুলে দিতে পারে, এটাই তার উদাহরণ।
প্রযুক্তির এই গণতন্ত্রায়ণই তৈরি করছে এমন এক পৃথিবী, যেখানে প্রতিভা আর পরিশ্রমই হয়ে উঠছে সাফল্যের একমাত্র মানদণ্ড। লিঙ্গ, জাতি, ভাষা বা অর্থনৈতিক অবস্থান নয়—যার মধ্যে আছে শেখার আগ্রহ, সে-ই এগিয়ে যাচ্ছে।
তরুণেরাই বদলে দেবে ভবিষ্যৎ
যদি কোনো কিছু সত্যিই ভালো লাগে, তবে সেখানে অসাধারণ কিছু করা যায়। নিজের আগ্রহ থেকেই আসে মনোযোগ আর ধৈর্য; যা শেখার পথকে সহজ করে। এমনকি এটি মানসিক শক্তিকেও দৃঢ় করে, চাপ বা ব্যর্থতার সময়ে এই প্রিয় কাজটাই হয়ে ওঠে আশ্রয়।
যাঁরা ভাবছেন, ‘আমি কী করতে পারি?’ তাঁদের বলব, বড় কিছু করতে ‘বড় কিছু’ লাগে না। দরকার কৌতূহল, শেখার আগ্রহ আর হাল না ছাড়া ধৈর্য। ভুল হবে, হতাশা আসবে, কেউ হয়তো গুরুত্ব দেবে না, কিন্তু প্রতিটি ভুলের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে শেখার পথ।
তরুণ প্রজন্ম প্রমাণ করছে, বয়স কোনো বাধা নয়, বরং সাহস ও সৃষ্টিশীলতাই বড় শক্তি। যে কৌতূহল থেকে একদিন তৈরি হয়েছিল রিদ্মিক কি-বোর্ড, সেই একই কৌতূহল হাজারো তরুণকে অনুপ্রাণিত করছে নতুন কিছু করতে। সেই নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই তৈরি হবে আরও বড় গল্প; যা বদলে দেবে ভাষা, সমাজ আর আমাদের ভবিষ্যৎ।