যে ভালো গল্প বলবে, সে-ই হবে ক্ষমতাবান
জি আই জো: রিটেলিয়েশন, নাউ ইউ সি মি ২, উইকেড–এর মতো জনপ্রিয় সব চলচ্চিত্রের নির্মাতা জন এম চু। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন এই চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন পরিচালক। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস আলটোস শহরের একটা ছোট্ট চায়নিজ রেস্তোরাঁ থেকে আমার গল্পের শুরু। নাম শেফ চু’স। মা-বাবা, যাঁরা আজ এই অনুষ্ঠানেও উপস্থিত আছেন, ১৯৬৯ সালে তাঁরা এই রেস্তোরাঁ শুরু করেছিলেন। আর ৫৬ বছর পর এখনো তা চলছে। আমার বাবার বয়স ৮২। এখনো প্রতিদিন কাজ করেন। তাইওয়ান থেকে যখন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে আমেরিকা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গল্প। ইংরেজি ভালো জানতেন না। কিন্তু এলভিস, বিটলস আর ডিন মার্টিনকে খুব ভালোবাসতেন।
স্টিভেন স্পিলবার্গ আর জর্জ লুকাসকে বিস্ময়কর মনে হতো। মাইকেল জ্যাকসনকে দেখে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, আমরা ভেসে বেড়াতে পারি। অন্যদিকে মাইকেল জর্ডান প্রমাণ করে দিতেন, আমরা উড়তেও পারি। স্টিভ জবস ছিলেন আমার শহরের নায়ক।
কিন্তু আমাদের ঘরে যে ক্ল্যাসিক মার্কিন রূপকথা চলত, তা ছিল ‘উইজার্ড অব অজ’। মা-বাবা শেখাতেন—যদি ‘হলুদ ইট বসানো পথ’ ধরে হাঁটি; অর্থাৎ বিশ্বাস, নিয়মানুবর্তিতা, কঠোর পরিশ্রম, আর নিজের পছন্দের কাজকে গুরুত্ব দিই, তাহলে এই পথ আমাদের নিয়ে যাবে সেই জাদুকরের কাছে, যে আমাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করবে।
বছরের সবচেয়ে বিশেষ মুহূর্তটা আসত তখন, যখন আমরা সবাই টিভির সামনে বসে অস্কার দেখতাম। হলিউডের সেই ঝলমলে মানুষগুলোকে মনে হতো ভীষণ সুন্দর, সংস্কৃতির পথপ্রদর্শক, ফ্যাশনের প্রতীক। তাঁরা যখন কথা বলতেন, করতালিতে ফেটে পড়ত পুরো পৃথিবী। কিন্তু বাস্তবে হলিউডে পৌঁছানো আমার জন্য ছিল অসম্ভব এক স্বপ্ন। যে রেস্তোরাঁর কাউন্টারে বসে হোমওয়ার্ক করতাম, সেখান থেকে যোজন যোজন দূরে হলিউড। ওই জগতে ঢোকার মতো কোনো পরিচিতি আমার ছিল না। মনে হতো, সেই দরজাগুলো এত উঁচু—আমাদের মতো দেখতে কাউকে তো দূরের কথা, অন্যদেরও যেন ঢুকতে দেওয়া বারণ।
তারপর একদিন ছোট্ট একটা সনি ক্যামকর্ডার পেলাম। ওটাই আমার জীবন পাল্টে দিল। যখন ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখলাম—চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেল, শুধু ছোট একটা আলো দেখা যাচ্ছিল। আমার চঞ্চল মন হঠাৎই শান্ত হয়ে গেল। সময় যেন থেমে গেল। সেই ছোট্ট আলোয় এমন কিছু মুহূর্ত দেখলাম, আগে কখনো যা দেখিনি। জীবনের ছোট ছোট দৃশ্য—বাবা মায়ের হাত ধরছেন, ভাই সিঁড়ি থেকে লাফ দিচ্ছে, জন্মদিনের উপহার খুলতে গিয়ে বোনের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠছে।
এই সবই যেন আমার একান্ত গোপন কিছু ছিল। কিন্তু ভিডিও ধারণের পর যখন টিভিতে চালাতাম, মনে হতো গোপন এই অনুভূতিগুলো যেন সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। টিভির সামনে বসে ওরা চিৎকার করে আমাকে ডাকত। বলত—‘জন, ক্যামেরা একটু নিচে নামাও! ক্যামেরা নাড়িও না! মাথাব্যথা হয়ে যাচ্ছে!’ যন্ত্রটা যেন সহানুভূতি তৈরি করত। এমন শক্তিশালী কিছু আগে কখনো পাইনি। এটা আমাকে আরও কৌতূহলী করে তুলল।
একবার ছুটিতে সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আনন্দের মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় ধারণ করে, মিউজিক বসিয়ে, সম্পাদনা করে ভিডিও বানিয়ে ফেললাম। বসার ঘরে সবাই একসঙ্গে বসে দেখলাম। টিভিতে নিজেদের ছবি দেখে, কয়েক মুহূর্তেই ভীষণ আবেগে মা-বাবার চোখ ভিজে এল।
আজও সেই ভ্রমণটা নিয়ে আমরা আমাদের পরিবারে কথা বলি। ভ্রমণের অনুভূতিটা নিয়ে নয়, বরং ভ্রমণের ভিডিও দেখার অনুভূতিই আমাদের আড্ডায় উঠে আসে। এলোমেলো কতগুলো ক্লিপকে যে জুড়ে দেওয়া যায়, জুড়ে দিয়ে একটা গল্পে রূপ দেওয়া যায়, সেই গল্প থেকে আসে আবেগ, আবেগ তৈরি করে সহানুভূতি। আর সেই সহানুভূতিই মানুষকে কিছু করার অনুপ্রেরণা দিতে পারে।
আজকের দিনে এই ব্যাপারগুলো আরও বেশি জরুরি। এ কারণেই আমি আজ তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। কারণ, এখন জ্ঞান পাওয়া অনেক সহজ—এআই দিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই তুমি তথ্য জেনে ফেলতে পারো। কিন্তু বোঝাপড়া আর সহানুভূতি পাওয়া অনেক কঠিন, আর তাই এখন আরও বেশি মূল্যবান। কেউ কেউ এটা আগেই বুঝে ফেলেছে। এখন এটা ব্যবসাও হয়ে গেছে।
গল্প বলাটা এখন আমাদের সবচেয়ে বড় আশা, আবার সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্রও। ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ, এমনকি এআই—সবাই চায় গল্পের নিয়ন্ত্রণ। যে ভালো গল্প বলবে, সে-ই হবে ক্ষমতাবান। তাই তুমি যে পেশাতেই যাও না কেন; গল্প বোঝার, বিশ্লেষণ করার এবং গঠন করার ক্ষমতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমার স্কুলে শুধু আমিই ভিডিও তৈরি করতাম। আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক বাচ্চার হাতে ফোন আছে, তারা জানে কীভাবে এডিট করতে হয়। এটা বিশাল পরিবর্তন, যার বড় প্রভাব আছে। এখন আর শুধু কনটেন্ট দেখে যাওয়ার দিন নেই। আমাদের হতে হবে সচেতন বিশ্লেষক, চিন্তাশীল নির্মাতা। আমরা যেন সত্য আর মিথ্যা, সত্যিকারের অনুভূতি আর কৃত্রিম অভিনয় আলাদা করতে পারি। মেশিন তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে, প্যাটার্ন বুঝতে পারে, এমনকি শিল্পও তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা সত্যিকারের অনুভব করতে পারে না, অন্যের অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।
যে ক্ষেত্রেই কাজ করো না কেন, অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার মতো করে তথ্য তুমি উপস্থাপন করতে পারো। এই ক্ষমতা যে কতখানি মূল্যবান, তা আমরা নিজেরাও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।
তাই অনুরোধ করব, গল্প বলার ক্ষমতাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করো। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, গল্প বলার শক্তির মাধ্যমেই তোমার নতুন নতুন ভাবনা সত্যিকারভাবে পৃথিবীতে প্রভাব ফেলবে।