চিকিৎসক যখন আয়রনম্যানের আসরে

আমাদের এই চিকিৎসক সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড়ের সমন্বিত ক্রীড়া ট্রায়াথলনের একজন খেলোয়াড়ছবি: সংগৃহীত

শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে, যে চিকিৎসকের কথা বলা হচ্ছে, তিনি বুঝি আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীদের চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। আসলে তা নয়, আমাদের এই চিকিৎসক সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড়ের সমন্বিত ক্রীড়া ট্রায়াথলনের একজন খেলোয়াড়। তিনি সাকলায়েন রাসেল। একজন ভাস্কুলার (রক্তনালি সম্পর্কিত) সার্জন। রাজধানীর ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত পৃথিবীর কঠিনতম ট্রায়াথলন আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত দুটি আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতা সফলভাবে শেষ করেছেন। সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল। সিঙ্গাপুর ও দেশে পূর্ণ দূরত্বের ম্যারাথনও সম্পন্ন করেছেন কয়েকটি। দৌড়, সাইক্লিং, সাঁতারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালেখি, সচেতনতামূলক ভিডিও নির্মাণ, দাতব্য কাজ—আরও অনেক কিছুই করেন তিনি। চিকিৎসাব্রতের মতো কঠিন একটা পেশায় থেকেও এত সব কীভাবে করেন, জানতে ২২ ডিসেম্বর রাত সাড়ে আটটায় ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটালে সাকলায়েন রাসেলের মুখোমুখি হই।

ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান সাকলায়েন রাসেল
ছবি: কবির হোসেন

সাকলায়েন রাসেলের ঘরে একটা দেয়ালজোড়া আয়না। ঘরটাকে তাই মনে হয় অনেক বড়। আয়নার পাশের দেয়ালে ঝুলছে আয়রনম্যান, ম্যারাথন ও সাঁতারের অনেকগুলো পদক। সবে অস্ত্রোপচার শেষ করে নিজের ঘরে ফিরেছেন সাকলায়েন, পরনে সবুজ পোশাক। ‘একজন রোগীর রিপোর্ট দেখব, তারপর কথা বলি,’ বললেন সাকলায়েন। আলো দিয়ে দেখলেন এক রোগীর পায়ের রিপোর্ট। বললেন, ‘পায়ের আলট্রাসনোগ্রাম দেখেছেন কখনো, আমরা এটাও করি। দেখেন এই পায়ের রক্তনালির কিছু অংশ শুকিয়ে গেছে।’ রোগীর স্বজনদের জানালেন, ‘এখন এক মাস ওষুধ দিয়ে দেখব। তবে উনাকে ধূমপান একদম ছেড়ে দিতে হবে। না হলে তেমন কিছু করা যাবে না।’

রিপোর্ট দেখা শেষ। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যথেষ্ট ব্যস্ত একজন চিকিৎসক, সার্জন। চিকিৎসক হয়ে আবার আয়রনম্যান হতে চাইছেন কেন? রাসেলের উত্তর—‘আমি মানুষকে সচেতন করতে চাই। নিজে করলে মানুষ আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হবে। আমি দেখেছি আমরা যাঁরা চিকিৎসক, তাঁরা মানুষকে সুস্থ করি, কিন্তু নিজেদের বিষয়ে খেয়াল রাখি কম। চিকিৎসকদের জীবনে স্ট্রেস (চাপ) অনেক বেশি। আমার মনে হলো চিকিৎসকদের ফিট থাকতে হবে। অনেক সময় টানা ১০–১২ ঘণ্টা অপারেশন থিয়েটারে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। ব্যায়াম করে, দৌড়াদৌড়ি করে বা সাঁতার কেটে এনার্জি গেইন (শক্তি লাভ) করি। সেই শক্তি যদি রোগীদের মধ্যে দিতে পারি সেটা তো ভালো। একই সঙ্গে নিজের শরীরটাও ঠিক থাকে।’

২০১৮ সাল থেকেই রমনা পার্কে জগিং করেন সাকলায়েন

২০২০ সালের মার্চ মাসে মহামারির শুরুতেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন সাকলায়েন রাসেল। ‘মাত্র চার দিন ঘরে ছিলাম। করোনাভাইরাসের নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই  হাসপাতালে আসি। আর আমার ডাক্তারদের দৌড়ের ওপর রাখি। হাসপাতাল তো চালাতে হবে,’ বলছিলেন তিনি।

আর এই দৌড়াদৌড়ির শুরুটা কীভাবে? সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকেই হাঁটি, রমনা পার্কে। আয়রনম্যান আরাফাতসহ কয়েকজন সেখানে দৌড়াতেন। একদিন আরাফাত বললেন, “আমাদের সঙ্গে ব্যায়াম করেন।” সেই থেকে শুরু।’ সাঁতার শুরুর গল্পটা আরও নাটকীয়। সাকলায়েন বলেন, ‘২০২০ সালের শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হই। আর ২০২০–এর শেষে চোখের জটিল এক রোগ আরডি (রেটিনা ডিটাচমেন্ট)–এ আক্রান্ত হই। বাঁ চোখে পানি জমে যায়, যার ভবিষ্যৎ পরিণতি অন্ধত্ব। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমার চিকিৎসক সাঁতার কাটার পরামর্শ দিলেন। তখন সাঁতারু সাইফুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের পুকুরে সাঁতার কাটা শুরু করি। আসলে আরাফাতরা আমার চোখ খুলে দেন। এভাবেই শুরু।’

২০২১ সালে ১৬.১ কিলোমিটারের বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেন সাকলায়েন রাসেল। ২০২২ ও ২০২৪ সালে মালয়েশিয়ার লংকাউতে অর্ধ দূরত্বের আয়রনম্যান ৭০.৩ সম্পন্ন করেন। আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতায় তাঁকে ১.৯ কিলোমিটার সাঁতার, ৯০ কিলোমিটার সাইক্লিং ও ২১.১ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করতে হয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। ২০২৪ সালে মালয়েশিয়াতেই নেমেছিলেন পূর্ণ দূরত্বের আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায়। ৩.৮ কিলোমিটার সাঁতারের পর ১২২ কিলোমিটার সাইক্লিং করেছেন। কিন্তু সময়ের কারণে বাকিটা আর সম্পন্ন করতে পারেননি। চলতি বছরই সাকলায়েন রাসেল যাবেন জার্মানির হামবুর্গে আয়রনম্যান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে। এটায় তিনি পূর্ণ আয়রনম্যান সম্পন্ন করতে পারবেন বলে আশা করছেন। ২০২৬ সালে থাইল্যান্ডে ওশানম্যান সাঁতারেও অংশ নেবেন। একই বছর মালয়েশিয়ায় অংশ নেবেন দৌড় ও সাইক্লিংয়ের পাওয়ারম্যান প্রতিযোগিতায়। আপাতত এসবই লক্ষ্য।

২০২৪ সালে অংশ নেন সিঙ্গাপুর ম্যারাথনে
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৮ সালের ৯ নভেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার রূপসী গ্রামে জন্ম সাকলায়েন রাসেলের। বাবা মো. সিরাজুল ইসলাম, মা রুবিয়া খাতুন। তাঁর পোশাকি নাম সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম (এসএমজি) সাকলায়েন। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এ কে হাইস্কুল থেকে এসএসসি। এরপর ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ‘মাকে হাসপাতালে রেখে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাই। তখনই ঠিক করি চিকিৎসক হতে হবে,’ বলেন রাসেল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পরই চাকরি শুরু করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে কার্ডিওভাস্কুলার অ্যান্ড থোরাসিক সার্জারিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। ১১ বছর পর সাকলায়েন রাসেলকে প্রধান করে ২০১৭ সালে ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ভাস্কুলার বিভাগ চালু করা হয়। তখন তিনি ছিলেন সহকারী অধ্যাপক। ২০২০ সালে হন সহযোগী অধ্যাপক।

আরও পড়ুন

২০০৮ সালে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ তারানা ফারিয়াকে বিয়ে করেন রাসেল। এই দম্পতির এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে আরিজ (১৩) ও মেয়ে আরিবা (১১)। আরিজ বিশেষ শিশু। তাকেও দিতে হয় বাড়তি সময়, নিতে হয় আলাদা যত্ন। মিঠাপুকুরে গ্রামের যে বাড়িটা আছে, সেটায় নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একটা বিদ্যালয় চালু করেছেন সাকলায়েন রাসেল। আরিজের নামেই স্কুল। স্কুলের সব খরচ রাসেলই বহন করেন। এখন এ স্কুলে ১৩২টি শিশু পড়াশোনা করে। যেকোনো দুর্যোগে সহযোগিতা করতে ৭৮ জন চিকিৎসককে নিয়ে ‘আমরাই বন্ধু’ নামে একটি দল গঠন করেছেন তিনি।

স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা লেখা লিখতেন সাকলায়েন রাসেল। তিনি একজন সংবাদপাঠকও। মাই টিভিতে ১৭ বছর ধরে সংবাদ পড়ছেন। নিউজ প্রেজেন্টারস অ্যাসোসিয়েশনের তিনি প্রেসিডেন্ট। আবার বাংলাদেশ ভাস্কুলার সোসাইটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদকও। করোনার সময় সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ইউটিউবে বেশি বেশি করে ভিডিও বানাতে শুরু করেন। লক্ষ লক্ষ ভিউ হতো তখন। এর বাইরে ‘ডেসপারেটলি সিকিং ডক্টর’ নামে একটা ফেসবুক গ্রুপও চালাতেন। ফলে সব সময়ই মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা তিনি করেছেন।

তুমুল ব্যস্ততার পরও সপ্তাহে ১২–১৩ ঘণ্টা করে শরীরচর্চা করেন রাসেল। কোনো দিন দৌড়, কোনো দিন সাইক্লিং আর কোনো দিন সাঁতার। ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বিষয়ে সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘ভাস্কুলার বিষয়ের পরিসর বাড়াতে চাই। একটা ফুল আয়রনম্যান সম্পন্ন করে। মানুষের আগ্রহ বাড়াতে চাই।’ তাঁর আরও ইচ্ছা বিশেষ শিশুদের জন্য কিছু করা।

আরও পড়ুন