অন্য এক ঢাকার নকশা করে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন বুয়েটের রিদওয়ান
স্থাপত্য বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা রিদওয়ান নূরের ছিল না। ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল। আর ছিল পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার স্বপ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগও পান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগেও আসে ভর্তির সুযোগ। তবে ঢাকার মানিকদীর এক ছোট চায়ের দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ঠিক করেন—যেহেতু ছবি আঁকতে ভালোবাসেন, স্থাপত্যেই পড়বেন। পরে বুঝতে পারেন ছবি আঁকা আর স্থাপত্যে পড়া এক নয়। কিন্তু তত দিনে বিষয় হিসেবে স্থাপত্য ভালো লেগে গিয়েছিল। আর স্নাতক শেষে সেই বিষয়ের পড়াশোনাই তাঁকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মাননা।
স্নাতক শেষ বর্ষে রিদওয়ানের থিসিস প্রকল্পের নাম ছিল ‘আরবান টিউন-আপ’। সম্প্রতি সেটিই পেয়েছে ‘গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫’–এর ‘গ্লোবাল উইনার’ স্বীকৃতি।
গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস (জিইউএ) স্নাতক পর্যায়ের সম্মানজনক পুরস্কার। প্রতিবছর ২৫টি আলাদা বিভাগে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। পৃষ্ঠপোষকতা করেন আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি হিগিনস। এ বছর পৃথিবীর খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জমা পড়া প্রায় ২ হাজার ৪০০ থিসিস থেকে বাছাই করা হয় বিজয়ী।
গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস ছাড়াও থিসিস প্রকল্পটি আর্কএশিয়া থিসিস অব দ্য ইয়ার ২০২৫–এ স্বর্ণপদক পেয়েছে। রিদওয়ান নূর বলেন, ‘কাজ শুরু করার সময় পুরস্কারের কথা মাথায় ছিল না, পুরস্কার সব সময়ই বাই-প্রোডাক্ট (উপজাত)। কাজটিই প্রধান। প্রজেক্টের সুপারভাইজার ছিলেন খন্দকার সাব্বির আহমেদ এবং মাহেরুল কাদের। তাঁরা আমাকে পথ দেখিয়েছেন। সাব্বির স্যার আমার মাস্টার্স প্রোগ্রামেরও সুপারভাইজার। ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছে আমি ভীষণ ঋণী।’
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে হবে এবারের বার্ষিক জিইউএ গ্লোবাল সামিট। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় ১৬তম এ সামিটে যোগ দেবেন আদনান নূর।
কী নিয়ে থিসিস
রিদওয়ান নূরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। জনবহুল এ শহরে যেটুকু সবুজ ও ফাঁকা ছিল, একটু একটু করে তাঁর চোখের সামনেই তা হারিয়ে গেছে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, এই শহরের সঙ্গে মানুষের কোনো আত্মিক যোগ নেই। এখানে মাঠ, পার্ক, জলাধার, লাইব্রেরির এতই সংকট যে মানুষের অবসর কাটানোর তেমন কোনো জায়গা নেই। চাইলেই তো এই শহরকে ভেঙেচুরে এগুলো নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তাই রিদওয়ান ভাবছিলেন, বিদ্যমান স্থাপনাগুলো ঠিক রেখেই কীভাবে জায়গা তৈরি করে মানুষকে সুবিধাগুলো দেওয়া যায়। এটিকে কেন্দ্র করেই তাঁর থিসিস প্রজেক্ট ‘আরবান টিউন-আপ’।
রিদওয়ান প্রথমত খেয়াল করলেন, শহরের ছাদগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। তিনি তাঁর থিসিসে দেখিয়েছেন, এই ছোট ছোট ছাদগুলোকে একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত করে গণপরিসর (পাবলিক স্পেস) তৈরি করা সম্ভব। যেমন দুটি বা তিনটি ছাদ জোড়া দিয়ে বাচ্চাদের একটি খেলার মাঠ হতে পারে। এরকমভাবে বৃদ্ধদের অবসর কাটানোর জায়গা, একসঙ্গে অনেকে মিলে সিনেমা দেখার জায়গা, সবুজায়নসহ নানা সম্ভাবনা তিনি দেখিয়েছেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেটের বদলে যাওয়া চেহারা কেমন হতে পারে, নকশায় দেখিয়েছেন রিদওয়ান। মেট্রোরেলের নিচের ফাঁকা জায়গা কীভাবে ওয়াকওয়ে হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা-ও তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর প্রত্যাশা, গণপরিসরগুলো এভাবে গড়ে তুলতে পারলে মানুষ ও শহরের মধ্যে মানবিক বন্ধন তৈরি হবে।
আঁকার সঙ্গে থাকা
ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার ঝোঁক। ভালোবাসতেন রম্য সাময়িকী উন্মাদ। উন্মাদ থেকেই কার্টুন আঁকার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। বন্ধুদের খাতা থেকে শুরু করে স্কুলের ম্যাগাজিন—সবখানে এঁকে বেড়াতেন। এরপর আঁকাআঁকিটা আর কখনো ছাড়েননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দ্বিতীয় বর্ষ থেকে দ্য ডেইলি স্টারের ম্যাগাজিন ‘শাউট’-এ আঁকতে শুরু করেন। তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন বড় ভাই অনুপম হোরকে সঙ্গে নিয়ে অংশ নেন ঢাকা কমিকসের ‘ওয়েব কমিকস’ প্রতিযোগিতায়। সেখানে তাঁর আঁকা ভৌতিক কমিকস ‘রমাপদবাবুর একদিন’ প্রথম স্থান অর্জন করে। এই অর্জন ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। তবে আঁকাআঁকিটাকে তিনি কখনো পেশা হিসেবে নিতে চাননি। তিনি বলেন, ‘এটা (ছবি আঁকা) শখ। শখ থাকতে হয়, শখ না থাকলে তো মন ক্লান্ত হয়ে যাবে!’ ছবি আঁকার এই শখ তাঁর পেশাগত জীবনে কাজে লেগেছে ভিন্নভাবে। ছবির মাধ্যমে তিনি তাঁর কথা সহজে বোঝাতে পারেন। থিসিসের জটিল বিষয়গুলোর সহজ উপস্থাপনেও সাহায্য করে তাঁর আঁকা ছবি।
শিক্ষকতার আনন্দ
রিদওয়ান নূরদের ‘শিক্ষক পরিবার’। মা নাসিমা আক্তার শিক্ষক। একান্নবর্তী পরিবারে দুই মামিও কলেজে শিক্ষকতা করছেন। স্নাতকে নিজ বিভাগে প্রথম হয়ে শিক্ষকতার সুযোগ রিদওয়ানেরও এসেছে। সেই সুযোগ হাতছাড়াও করেননি। শুরুতে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এ বছর এপ্রিলে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। আঁকাআঁকি, গবেষণা আর শিক্ষকতার মাঝে শিক্ষকতার কাজটিই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন রিদওয়ান নূর।
সম্প্রতি বিয়ে করেছেন এই তরুণ। সহধর্মিণী ফারিহা হোসেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন তিনি। ‘আরবান টিউন আপ’ এর ভাবনা তাই দুজনের জন্যই রোমাঞ্চকর।
বর্তমানে বুয়েটেই স্নাতকোত্তর করছেন রিদওয়ান। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও স্থায়ী হওয়ার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। অর্জিত জ্ঞান দেশেই কাজে লাগাতে চান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থাপত্য বিভাগ নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেন। রিদওয়ান আক্ষেপ করে বলছিলেন, এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই নানা সৃজনশীল উদ্ভাবন উপহার দিলেও এসবের প্রয়োগ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। তিনি চান, শিক্ষার্থীদের ভাবনাগুলো যেন বাস্তব রূপ পায়।