এক বন্ধু বুয়েটে প্রথম, আরেকজন মেডিকেলে দ্বিতীয়
আজ আগস্ট মাসের প্রথম রোববার—বন্ধু দিবস। পড়ুন বন্ধুত্বের একটি অন্যরকম গল্প।
আলাপটা শুরু হয়েছিল ব্রেকিং ব্যাড দিয়ে। সাড়া–জাগানো এই টিভি সিরিজ নিয়ে ক্লাসরুমের এক কোণে জমে উঠেছিল দুই সহপাঠীর আড্ডা। কোন দৃশ্য সবচেয়ে স্মরণীয়, গল্পটা কোথায় গিয়ে চূড়ান্ত বাঁক নিয়েছে—এসব আলোচনা করতে করতেই জমে ওঠে বন্ধুত্ব। বলছিলাম তোফায়েল আহমেদ ও সানজিদ অপূর্ব বিন সিরাজের কথা। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সকালে তাঁদের প্রথম দেখা। দুজনই তখন সদ্য চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ক্লাসে সেদিন একসঙ্গেই বসেছিলেন। পরিচয়পর্ব শেষে সিনেমা আর সিরিজের দিকে গড়ায় আলাপ। ব্রেকিং ব্যাড, পিকি ব্লাইন্ডার্স, ফ্রেন্ডস...দুজনের পছন্দের তালিকায় একই নাম! তাই আড্ডাও চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
সিনেমা থেকে গান, গান থেকে বই—নানা দিকে বিস্তৃত হয় বন্ধুত্বের পথ। নতুন ব্যান্ডের গান শোনা, গল্প করা, বইয়ের পাতা উল্টে একে অন্যকে সাজেশন—এসবের মধ্য দিয়ে বোঝাপড়াটা আরও মজবুত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও দুই বন্ধু রেখেছেন মেধার স্বাক্ষর। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়েছেন তোফায়েল, আর মেডিকেলে দ্বিতীয় সানজিদ।
পড়ালেখার বাইরে
একজনের লক্ষ্য ছিল প্রকৌশল, অন্যজনের মেডিকেল। লক্ষ্য ভিন্ন হলেও তাঁদের পছন্দের বিষয়গুলোতে অনেক মিল। তোফায়েল বলছিলেন, ‘আমরা দুজনই সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ দেখতে পছন্দ করি। এখনো দেশ-বিদেশের নানা পরিচালকের তৈরি করা সিনেমা দেখি। নতুন সিনেমা এলে দুজনই দুজনকে জানাই। ফরেস্ট গাম্প যেমন একসঙ্গে দেখেছিলাম।’
সাহিত্যের নানা বই পড়তে ভালোবাসেন তোফায়েল। তাঁর বাসায় বই আছে প্রায় আড়াই শ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদ—কিচ্ছু বাদ নেই। সানজিদ জানালেন—বিভূতি, হুমায়ূন, অনেক লেখকের বই তিনি তোফায়েলের কাছ থেকে নিয়ে পড়েছেন। এভাবে বই চালাচালি, সিনেমা, গানের পাশাপাশি আড্ডায় চলে রাজনীতি আর সমাজ নিয়ে আলাপ। তর্ক-বিতর্ক হয়, কিন্তু ঝগড়ায় গড়ায় না।
সানজিদ ভালোবাসেন হিপহপ, রক। তাঁর প্রিয় শিল্পী মার্কিন র্যাপার জুস ওয়ার্ল্ড। সানজিদের আগ্রহ দেখে তোফায়েলও র্যাপ, হিপহপ শুনতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি দুজনেরই প্লেলিস্টে আছে মাইলস, আর্টসেল, ওয়ারফেজ, শিরোনামহীনের গান।
দুই বন্ধুর দুই স্বপ্ন
সানজিদের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার গারাংগিয়া গ্রামে। বাবা ছিলেন কলেজশিক্ষক। ২০১৪ সালে কোলন ক্যানসারে তিনি মারা যান। বাবার মৃত্যু সানজিদকে নাড়া দিয়েছিল গভীরভাবে। সেদিন থেকেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, চিকিৎসক হবেন। কাজ করবেন ক্যানসার নিয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষ থেকেই শুরু করেন ভর্তিপরীক্ষার প্রস্তুতি। এখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। অন্যদিকে তোফায়েলের জন্ম কুমিল্লার পূর্ব চান্দিপুরে। মা মিনা বেগম, বাবা মনিরুল ইসলাম। ছোটবেলায় সরাইপাড়ার সিটি করপোরেশন স্কুলে পড়াশোনা শেষ করেন। কলেজে ওঠার পর কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর আগ্রহ গভীর হয়। সেই আগ্রহ থেকেই এবার বুয়েটে ভর্তি হলেন।
শহর ঘোরা, তর্ক-বিতর্ক—সবই চলত একসঙ্গে। কিন্তু তাঁদের পড়াশোনায় কখনো ব্যাঘাত ঘটেনি। গণিত দুজনেরই প্রিয় বিষয়। সানজিদ বললেন, ‘আমরা দুজনেই ক্লাসের নোট ভাগ করে নিতাম। কখনো আমি সাহায্য করতাম, কখনো তোফায়েল।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়ও দুজনের প্রস্তুতি ছিল পরিকল্পনামাফিক। তাঁরা প্রতিদিন ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করতেন। সময়ের হিসাব রাখতেন না। কখনো টানা ১০ ঘণ্টা পড়তেন, কখনো আরও বেশি। তবে এত ভালো ফলাফল হবে, তা ভাবেননি।
সানজিদ জানালেন, মেডিকেলে তাঁর ক্লাস শুরু হয়েছে মাত্র পাঁচ দিন। তোফায়েল বুয়েটে ক্লাস শুরু করেছেন আরও মাস তিনেক আগে। ক্লাস শেষে প্রায় সময় তাঁরা আড্ডা দেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। এখন পড়াশোনার গন্তব্য আলাদা, ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। তবু দুজনের বিশ্বাস, সম্পর্কে কোনো চিড় ধরবে না। যে আড্ডা শুরু হয়েছিল ক্লাসরুমের বেঞ্চে; সিনেমা, গান আর বইয়ের আলোয় তা বেঁচে থাকবে।