ঢাকার পাশেই নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে যে ওয়াকওয়ে

নদীর পাড়ে বাঁধানো রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার মজাই আলাদা
ছবি: সুমন ইউসুফ

ভাবুন তো, শীতের সকালে মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে নদীর পাড়ে বাঁধানো রাস্তায় একমনে মর্নিং ওয়াক করছেন। আপনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মর্নিং ফ্লাইংয়ে নেমেছে পানকৌড়ি আর চিলের দল। নদীতে ছুটে চলেছে ডিঙিনৌকা। এ রকম একটা ওয়াকওয়ে ঢাকার বুকেই অপেক্ষা করছে!

কোথায় এই ওয়াকওয়ে

এই ওয়াকওয়ের একটি অংশ ইস্টার্ন হাউজিংয়ের স্লুইসগেট থেকে শুরু হয়ে তামান্না ওয়ার্ল্ড ফ্যামিলি পার্ক, নবাবেরবাগ, মিরপুর–১ হয়ে গাবতলীতে গিয়ে শেষ হয়েছে। নভেম্বরের ২৬ তারিখ সকালবেলা এই ওয়াকওয়েতেই হাঁটতে গিয়েছিলাম আমরা। মিরপুর পল্লবী মেট্রোরেল স্টেশন থেকে একটু এগোলেই হাতের ডানে একটা গলি পাওয়া যাবে। এই গলি ধরে গেলেই মিরপুর বেড়িবাঁধ। বেড়িবাঁধে উঠে তামান্না ওয়ার্ল্ড ফ্যামিলি পার্ক ধরে কাঙ্ক্ষিত ওয়াকওয়ের সামনে হাজির হই।

আরও পড়ুন

মুখর পথ

ওয়াকওয়ে থেকে দেখা যাবে এমন মনোরম দৃশ্য
ছবি: সুমন ইউসুফ

নিচ থেকে একে একে ২০টি সিঁড়ি বেয়ে ওয়াকওয়েতে উঠতেই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। ফজরের নামাজ পড়েই এখানে হাঁটতে চলে আসেন। বললেন, ‘এক্কেবারে নিরিবিলি পরিবেশ। কোনো কোলাহল ও গাড়ির হর্ন নেই, আছে শুধুই মানুষজনের হেঁটে চলা।’
কিছুটা পথ হাঁটতেই তুরাগ সিটি থেকে আসা মাঝবয়সী দুই নারীর সঙ্গে দেখা। ওয়াকওয়েতে একটু একটু হাঁটছেন আর দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছেন। কথা বলে জানা গেল, প্রায় প্রতিদিনই এখানে আসেন তাঁরা।
তাঁদের সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই দৌড়াতে দৌড়াতে সামনে এসে পড়েন মোজাক্কির হোসেন। এই যুবক জানালেন, দুই মাস ধরে প্রতিদিন সকালে রুটিন করে এখানে দৌড়াতে আসেন। দৌড়ানোর জন্য এই ওয়াকওয়েই কেন বেছে নিলেন, জানতে চাইলে বললেন, দৌড় বা মর্নিং ওয়াকের জন্য সাধারণত বাসায় কাছাকাছি কোনো রাস্তাই আমরা বেছে নিই। এসব রাস্তায় ধুলাবালু, ময়লা, গাড়ির হর্ন, শব্দদূষণ থেকে শুরু করে সব রকমের দূষণই থাকে। এমন রাস্তায় হেঁটে উপকারের চেয়ে স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলছি কি না, ভাবা দরকার। বদলে এ ধরনের ওয়াকওয়েতে মুক্ত বাতাসে হাঁটা শরীরের জন্য বেশি উপকারী।

কিছুদূর পরপরই বসার ব্যবস্থা। হাঁটা শেষ করে তেমনই একটা বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন নবাবেরবাগ থেকে আসা কাজল আহমেদ। বললেন, সকালে হাঁটা শেষে অনেকেই তরতাজা মাছ কিনে বাসায় ফেরেন। কাছেই গরান চটবাড়ি বটতলায় জেলেরা নদীর তরতাজা দেশি মাছ বিক্রি করেন।

ওয়াকওয়ে গড়ে ওঠার পেছনের গল্প

এই ওয়াকওয়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ কিলোমিটার
ছবি: সুমন ইউসুফ

ঢাকার চারপাশের নদী রক্ষা প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু জাফর মোহাম্মদ শাহজাহান কবির মুঠোফোনে জানালেন, ‘সকাল থেকে শুরু করে বিকেলে ঘুরতে আসা শত শত মানুষের উপস্থিতির কারণে দারুণ এক বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই ওয়াকওয়ে। শুক্রবারের মতো ছুটির দিনগুলোতে চোখে পড়ে উপচে পড়া ভিড়। আমাদের কাজ এখনো চলমান। তবে এরই মধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছেন নগরবাসী। আশা করছি, সামনে আরও বাড়তি সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মানুষের যে স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ থাকে, সন্ধ্যার পরও যেন তা অটুট থাকে, সে জন্য ওয়াকওয়েতে যুক্ত হবে সোলার লাইট। থাকবে নিরাপত্তাব্যবস্থা।’
শাহজাহান কবির আরও যোগ করেন, ঢাকাকে ঘিরে রেখেছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার মতো চারটি প্রধান নদ–নদী। পাড়ের দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার, দুই পাড় মিলে ২২০ কিলোমিটার।

এই নদীগুলোর দুই পাশ দখলমুক্ত রাখতে সীমানা পিলার বসানো থেকে শুরু করে তীর ঘেঁষে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বসার বেঞ্চ, ইকোপার্ক, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি কাজ হাতে নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। যেহেতু সর্বত্র সমানভাবে অবৈধ স্থাপনা দখলমুক্ত করা যায়নি, তাই শুরুতে পুরান ঢাকার শ্যামপুর, গাবতলী ও টঙ্গী নদীবন্দরের নিকটবর্তী অংশে বিক্ষিপ্তভাবে এই ওয়াকওয়ের নির্মাণকাজ চলে। একই সঙ্গে শ্যামপুরে নির্মিত হয় পরিবেশবান্ধব একটি ইকোপার্ক। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫২ কিলোমিটার অংশের ওয়াকওয়ের নির্মাণকাজ এখনো চলমান। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া কাজ ২০২৬–এর জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে মিরপুর বেড়িবাঁধের মতো জনবহুল এলাকার প্রায় ৬ কিলোমিটারজুড়ে বসবে সোলার লাইট, ফলে সন্ধ্যার পরও নির্বিঘ্নে ওয়াকওয়েতে চলাচল করতে পারবে নগরবাসী।

আরও পড়ুন

ওয়াকওয়েতে হাঁটার সময়

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে সন্ধ্যা নামার আগেই ওয়াকওয়ে ত্যাগ করতে পারলে ভালো
ছবি: সুমন ইউসুফ
  • ওয়াকওয়েতে হাঁটার সময় স্বাস্থ্যসচেতনতার পাশাপাশি কিছু নিরাপত্তাবিধিও মেনে চলা জরুরি। হাঁটা বা দৌড়ের সময় কানে হেডফোন গুঁজে গান না শোনাই ভালো। শুনলেও ভলিউম কমিয়ে আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে হবে।

  • বৃষ্টির দিনে পথ পিচ্ছিল থাকতে পারে, তাই উপযোগী সোলের জুতা পরা প্রয়োজন।

  • নদীর ধারে শিশুদের নিয়ে গেলে সর্বোচ্চ সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।

  • ওয়াকওয়েতে মানুষের পাশাপাশি কুকুরও উঠে পড়ে। তাই কুকুর দেখলে ভড়কে যাবেন না। ওর চলার জন্য জায়গা ছেড়ে দিন।

  • হাঁটার সময় প্লাস্টিক, খাবারের প্যাকেট বা পানির বোতল যত্রতত্র না ফেলে নির্ধারিত ডাস্টবিনে ফেলুন। নদীর পানি দূষণমুক্ত রাখা আমাদের দায়িত্ব।

  • একই রাস্তায় কেউ হাঁটেন, কেউবা দৌড়ান। যাঁরা দৌড়ান, তাঁরা ধীরগতিতে হাঁটা অন্য পথচারীদের বিরক্ত না করে পাশ দিয়ে চলে যান।

  • ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে খুব ভোর বা ঘোর সন্ধ্যায় একার বদলে দু-একজন মিলে হাঁটুন। সন্ধ্যা নামার আগেই ওয়াকওয়ে ত্যাগ করতে পারলে ভালো।

  • ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি থাকলে অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়িয়ে ধীরে ধীরে হাঁটা ভালো। প্রয়োজনে একটুখানি বিশ্রাম নিতে পারেন। ওয়াকওয়েতে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসার ব্যবস্থা আছে।

আরও পড়ুন