বিখ্যাত সব জাদুঘরে আলোচিত ৮ চুরির ঘটনা, যা গল্পকেও হার মানায়
গল্প–সিনেমায় অনেক দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা আমরা পড়েছি বা দেখেছি। সেসব কল্পকাহিনিকে টেক্কা দিয়েছে সাম্প্রতিক এক চুরির ঘটনা। ১৯ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে দিনের আলোয় চার মিনিটে চুরি হয়ে গেছে নেপোলিয়ন যুগের মূল্যবান একাধিক রত্ন। চুরিটা হয়েছে ল্যুভরের অ্যাপোলো গ্যালারিতে। জাদুঘর থেকে শিল্পকর্ম বা রত্ন চুরি যাওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসাও খোয়া গিয়েছিল জাদুঘর থেকে। বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত সব জাদুঘরের আলোচিত ৮টি চুরির ঘটনা রইল এখানে।
ল্যুভর জাদুঘরে মোনালিসা চুরি
১৯১১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘর থেকে চুরি যায় বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রশিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চির চিত্রকর্ম মোনালিসা। কোটের নিচে লুকিয়ে হেঁটে ল্যুভর জাদুঘর থেকে বেরিয়ে যান ইতালীয় নাগরিক ভিনসেনসো পেরুজ্জা। এই চুরিকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় শিল্প চুরি।
মোনালিসা চুরির দুই বছর পর, ১৯১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পেরুজ্জাকে গ্রেপ্তারের পর ফ্লোরেন্সে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পেরুজ্জা তখন জানান, ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট সোমবার সকাল ৭টার দিকে জাদুঘর কর্মীদের দরজা দিয়ে তিনি ল্যুভরে ঢোকেন।
জাদুঘরের কর্মীরা যে সাদা পোশাক পরতেন, তিনিও তেমন পোশাক পরে ঢুকেছিলেন। তখন ল্যুভর প্রায় ফাঁকা ছিল। পেরুজ্জা ইতালির মোনালিসাকে ইতালিতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এই চুরি করেছিলেন বলেও দাবি করেছিলেন।
আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে রত্ন চুরি
১৯৬৪ সালে জ্যাক মার্ফ নামের এক গয়না চোর হানা দেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে। এই চুরির জন্য জ্যাকের নাম হয়ে যায় ‘মার্ফ দ্য সার্ফ’ হিসেবে। জ্যাক জাদুঘরের প্রাচীর বেয়ে ভেতরে চলে যান।
তারপর একে একে ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’সহ নীলকান্তমণি, রুবি ও হীরা চুরি করে পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে জ্যাক ধরা পড়েন ও চুরির দায়ে জেল খাটেন।
ইজাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়ামে চিত্রকর্ম চুরি
১৯৯০ সালে এক চুরির ঘটনায় তাজ্জব বনে যায় বিশ্ববাসী। ঘটনাটি ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের বোস্টন শহরের বিখ্যাত ইজাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়ামে। সেখানে পুলিশ কর্তা সেজে চুরি করতে আসেন দুজন।
তাঁরা মোট ১৩টি শিল্পকর্ম নিয়ে পালিয়ে যান। এর মধ্যে বিখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ডের তিনটি ও ইয়োহানেস ভার্মিয়েরের একটি চিত্রকর্ম ছিল। সব মিলিয়ে চুরি যাওয়া পণ্যের মূল্য ছিল ৫০ কোটি ডলারের বেশি। এসব শিল্পকর্ম আর কখনোই উদ্ধার করা যায়নি। চুরির প্রতীক হিসেবে জাদুঘরটিতে আজও খালি ফ্রেম ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
অসলো ন্যাশনাল গ্যালারিতে চিত্রকর্ম চুরি
বিখ্যাত নরওয়েজীয় চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মুঙ্কের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য স্ক্রিম’। এটি মূলত একটি সিরিজ।
১৯৯৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নরওয়ের লিলিহ্যামারে পর্দা উঠেছিল শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের। আর সেদিনই অসলো ন্যাশনাল গ্যালারিতে ঘটে এক অবিশ্বাস্য চুরির ঘটনা। দুই ব্যক্তি সেখানে ঢুকে এডওয়ার্ড মুঙ্কের ‘দ্য স্ক্রিম’ চুরি করে নিয়ে যায়।
রসিক চোরেরা ঘটনাস্থলে রেখে যায় একটি নোট, তাতে লেখা ছিল—‘দুর্বল নিরাপত্তার জন্য ধন্যবাদ।’ অলিম্পিক উপলক্ষে চিত্রকর্মটি তখন নিচতলার এক গ্যালারিতে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।
চুরির এক মাস পর, মার্চে, চোরেরা গ্যালারি কর্তৃপক্ষের কাছে ১০ লাখ মার্কিন ডলার দাবি করে। কিন্তু গ্যালারি টাকা দিতে অস্বীকার করলে নরওয়ের পুলিশ ফাঁদ পেতে অভিযান চালায়। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ৭ মে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ‘দ্য স্ক্রিম’।
মুঙ্ক গ্যালারিতে চিত্রকর্ম চুরি
মুঙ্কের এই চিত্রকর্মের ওপর চোর–ডাকাতদের বদনজর ছিলই। ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট দিবালোকে অসলো শহরের মুঙ্ক মিউজিয়ামে মুখোশধারী দুই সশস্ত্র ডাকাত ঢুকে পড়ে। এবার তারা চুরি করে নিয়ে যায় মুঙ্কের ‘দ্য স্ক্রিম’–এর ১৯১০ সালের সংস্করণটি, সঙ্গে ‘ম্যাডোনা’ নামের চিত্রকর্মটিও। ঘটনাস্থলে থাকা এক পথচারী ডাকাতদের গাড়ি চেপে পালানোর সময় ছবি তুলে ফেলেন।
২০০৫ সালের এপ্রিলে এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও চিত্রকর্ম দুটি তখনো নিখোঁজ ছিল। গুজব ছড়ায়, প্রমাণ নষ্ট করতে চোরেরা ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে। একই বছরের জুনে অসলো সিটি সরকার ২০ লাখ নরওয়েজিয়ান ক্রোন পুরস্কার ঘোষণা করে।
২০০৬ সালের শুরুতে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা চলে, যাঁদের মধ্যে তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত করে ৪ থেকে ৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুজনকে ৭৫০ মিলিয়ন ক্রোন ক্ষতিপূরণও দিতে বলা হয়। এরপর নিরাপত্তা সংস্কারের জন্য মুঙ্ক মিউজিয়াম প্রায় ১০ মাস বন্ধ থাকে।
অবশেষে ২০০৬ সালের ৩১ আগস্ট পুলিশ জানায়, ‘দ্য স্ক্রিম’ ও ‘ম্যাডোনা’ উদ্ধার হয়েছে এবং দুটিই প্রত্যাশার চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে।
২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে চিত্রকর্ম দুটি সংক্ষিপ্ত প্রদর্শনীতে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। জাদুঘর সংস্কার শেষে ২০০৮ সালে ‘স্ক্রিম অ্যান্ড ম্যাডোনা—রিভিজিটেড’ প্রদর্শনীর মাধ্যমে সেগুলো আবার প্রদর্শিত হয়।
অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামে চিত্রকর্ম চুরি
২০০০ সালে নতুন শতাব্দীকে স্বাগত জানাতে বিশ্বজুড়ে আতশবাজি ফোটানোর ধুম পড়ে যায়। ঠিক সে সময় আতশবাজি বিস্ফোরণে ভেঙে যায় ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামের স্কাইলাইট বা ছাদের জানালা।
এই ফাঁকে চোরেরা ধোঁয়া–বোমা ফাটিয়ে চুরি করে বিখ্যাত ফরাসি চিত্রশিল্পী পল সেজ্যানের আলোচিত ‘ভিউ অব অভের-সুর-ওয়াজ’ নামের চিত্রকর্মটি। আজও সেটির কোনো হদিস মেলেনি।
কুনৎসহিস্টোরিশেস মিউজিয়ামে লবণদানি চুরি
২০০৩ সালের ১১ মে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার কুনৎসহিস্টোরিশেস মিউজিয়াম থেকে খোয়া যায় বিখ্যাত এক লবণদানি, যা আদতে অতিমূল্যবান ভাস্কর্যও বটে।
‘সেলিনি সল্ট সেলার’—ভিয়েনায় বলে ‘সালিয়েরা’, শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দভান্ডার থেকে। এর অর্থ ‘লবণদানি’। ভাস্কর্যটি গড়েছেন ইতালীয় শিল্পী বেনভেনুতো সেলিনি। সোনা দিয়ে গড়া ভাস্কর্যটি গড়া হয়েছিল মূলত ১৫৪৩ সালে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়ার জন্য।
যাহোক, লবণদানিটি চুরি যাওয়ার সময় জাদুঘরে সংস্কারকাজ চলছিল। তাই ভবনটি ঘেরা ছিল স্ক্যাফোল্ডিং (নির্মাণকাজের জন্য অস্থায়ী কাঠামো) দিয়ে। চোর অ্যালার্ম চালু করলেও, সেটিকে ভুল সংকেত ভেবে কেউ আমলে নেয়নি। ফলে চুরির ঘটনাটি পরদিন সকাল ৮টা ২০ মিনিট পর্যন্ত টেরই পাওয়া যায়নি।
লবণদানিটি উদ্ধারের জন্য জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ১০ লাখ ইউরো পুরস্কার ঘোষণা করে। প্রায় তিন বছর পর, ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি, ভিয়েনা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার উত্তরে জভেটল শহরের কাছে এক বনে সিসার বাক্সে পুঁতে রাখা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় লবণদানিটি।
চোর রবার্ট মাঙ্গকে আদালত চার বছরের কারাদণ্ড দেন। লবণদানিটির বিমা মূল্য ধরা হয় প্রায় ৬ কোটি মার্কিন ডলার, যা বিমা করে অস্ট্রিয়ার ইউনিকা ইনস্যুরেন্স গ্রুপ।
প্যারিস মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে চিত্রকর্ম চুরি
ফরাসি নাগরিক ভেরান তোমিক চুরিতে এমন ঝানু আর দেয়াল বেয়ে অবলীলায় উঠতে পারেন বলে তাঁর নামই হয়ে গেছে ‘স্পাইডার–ম্যান অব প্যারিস’। তোমিক ২০১০ সালে প্যারিসের মিউজে নাসিওনাল দাখ মোদেন বা প্যারিস মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে ঢুকে পড়েন জানালা দিয়ে।
আর চুরি করেন বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ফরাসি চিত্রশিল্পী অঁরি মাতিস, ইতালীয় চিত্রশিল্পী আমেদিও মোদিলিয়ানি, ফরাসি চিত্রশিল্পী জর্জ বাক ও ফেহ্নো লিজির বিখ্যাত পাঁচটি মাস্টারপিস। এসব চিত্রকর্ম শুধু ভালো লেগেছিল বলেই চুরি করেছিলেন তোমিক।
তাঁর চুরি করা চিত্রকর্মগুলোর দাম সব মিলিয়ে ৮৫ মিলিয়ন ডলার ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরে অজ্ঞাত এক সূত্রের তথ্যমতে, পুলিশ তোমিককে গ্রেপ্তার করে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান