চুয়েটের এই শিক্ষকের সহায়তায় বিদেশে পড়ালেখা, চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী

অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম নিজেও চুয়েট স্নাতক
ছবি: অধ্যাপক সায়েমের সৌজন্যে

পিএইচডি ডিগ্রি ছিল, ছিল বিদেশে ভালো চাকরি করার সুযোগ। ফলে চাইলেই ভিনদেশের ঝাঁ–চকচকে নিরাপদ জীবন বেছে নিতে পারতেন আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম। তবু শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে চেয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের এই অধ্যাপক বর্তমানে পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত চুয়েটের ৩২ জন শিক্ষার্থী নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় পূর্ণ বৃত্তিসহ স্নাতকোত্তর করার সুযোগ পেয়েছেন।

নরওয়ের এগডার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চলমান একটি প্রকল্পের আওতায় ভিন্ন দুই মেয়াদে যোগ দিয়েছেন ২৫ জন—পাঁচ মাস মেয়াদি মাস্টার্স ইন রিনিউয়েবল এনার্জি প্রোগ্রামে ১৬ জন এবং দুই বছর মেয়াদি মাস্টার্স কোর্সে ৯ জন। আগামী বছরেও ৭ জন শিক্ষার্থীর নরওয়ে যাওয়ার কথা আছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি চুয়েটের ১০ জন শিক্ষক সেখানে পাঠদান কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে নরওয়ের ১০ জন শিক্ষার্থী ও ১০ জন শিক্ষকও চুয়েটে আসবেন। এই প্রকল্প ছাড়াও অধ্যাপক সায়েমের সহযোগিতায় গ্লোবাল কোরিয়া স্কলারশিপের আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ার কংজু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন শিক্ষার্থী এবং অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড (সিকিউ) বিশ্ববিদ্যালয় এলিভেট স্কলারশিপের আওতায় ৫ জন শিক্ষার্থী মাস্টার্সের সুযোগ পেয়েছেন।

আরও পড়ুন

অধ্যাপক সায়েমের উদ্যোগে বিদেশে পড়ার সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা মনে করেন—এই বৃত্তিগুলো কেবল মেধাবীদের নয়, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যও স্বপ্ন পূরণের দরজা খুলে দিয়েছে। নরওয়ে থেকে পাঁচ মাস মেয়াদি মাস্টার্স থিসিস করে আসা চুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সুরভী আক্তার বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবার একসময় চরম অর্থসংকটের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। বিএসসি করার সময় থেকেই পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার পাশাপাশি বিদেশে উচ্চশিক্ষারও ইচ্ছা ছিল। স্নাতক শেষ করার পরপরই সায়েম স্যারের অধীন গবেষণা সহকারী হিসেবে আমার পেশাগত যাত্রা শুরু হয়। মাস্টার্স অধ্যয়নের সময় স্যারের সহযোগিতা ও পরামর্শে নরওয়েতে শিক্ষাবৃত্তি পাই। দেশে ফিরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি, পিএইচডি করারও পরিকল্পনা আছে।’

শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতেই দেশে ফিরেছিলেন এই শিক্ষক
ছবি: অধ্যাপক সায়েমের সৌজন্যে

শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি

অস্ট্রেলিয়ার সিকিউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে ব্রিসবেন সিটি করপোরেশনে কৌশলগত সম্পদ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত আছেন চুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এফ এম নিজাম উদ্দিন খান। শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা চারজন উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি খুঁজছিলাম। সিকিউ বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সালে শিল্প পেশাদারদের জন্য একটি বৃত্তি চালু করে। সেখানকার অধ্যাপক ও ডিনদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় অধ্যাপক সায়েম স্যারই প্রথম এ সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনিই আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করেন।’

দক্ষিণ কোরিয়ার কংজু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আশহার ইনতেযাম বলেন, ‘স্নাতক শেষে দীর্ঘ সময় বাইরে শিক্ষাবৃত্তির জন্য চেষ্টা করেছি। তবে পছন্দমতো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। সে সময়ে সায়েম স্যার কোরিয়ার শিক্ষাবৃত্তিটি সম্পর্কে জানান। আবেদন করার পথ দেখানো থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে স্যার পাশে ছিলেন। স্যারের নিরলস সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধান ছাড়া এই শিক্ষাবৃত্তি অর্জন সম্ভব ছিল না। আমি এখানে তিন বছর পড়াশোনা করব। এ জন্য দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বছরে ৬০ লাখ টাকা শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছে।’

চলমান একটি প্রকল্পের আওতায় গত বছর নরওয়ের এগডার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রমে অংশ নেন চুয়েটের মেকানিক্যাল ও ম্যানুফ্যাকচারিং অনুষদের ডিন কাজী আফজালুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা দুজন শিক্ষক সেখানে পাঠদানের সুযোগ পেয়েছিলাম। তাদের পাঠ্যক্রম, গবেষণা কার্যক্রম ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পেরেছি। আমাদের শিক্ষার্থীরাও সেখানে পড়াশোনা করছে। তাদের ল্যাবরেটরি ও শিক্ষার পরিবেশ তুলনামূলকভাবে উন্নত হওয়ায় এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ও গবেষণার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এরই মধ্যে নরওয়ে থেকেও দুজন শিক্ষার্থী চুয়েটে এসে গবেষণা করেছেন। এমন বিনিময় কার্যক্রমে দুই পক্ষই সমানভাবে উপকৃত হচ্ছে।’

এসব শিক্ষাবৃত্তির পেছনের গল্প জানতে চাইলে অধ্যাপক সায়েম বলেন, ‘আমার শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করাই আমার বড় লক্ষ্য। ২০২১ সালে আমার ছাত্র নরওয়ের এগডার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌমেন রুদ্রর সহযোগিতায় সেখানকার কেন্দ্রীয় সরকারের আহ্বানে একটি গবেষণা প্রকল্প জমা দিই। প্রথমে বাতিল হয়ে গেলেও পরে আমাদের প্রচেষ্টায় এটি অনুমোদিত হয়। এর পর থেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এর ফলেই গ্লোবাল কোরিয়া স্কলারশিপের আওতায় দুজন শিক্ষার্থী দক্ষিণ কোরিয়ার কংজু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অস্ট্রেলিয়ার সিকিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিভেট স্কলারশিপে পাঁচজন শিক্ষার্থী মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন এরই মধ্যে পড়াশোনা শেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত।’

আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম
ছবি: অধ্যাপক সায়েমের সৌজন্যে

শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরি

উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানেরও সুযোগ করে দিচ্ছেন অধ্যাপক সায়েম। তাঁর উদ্যোগেই সম্প্রতি চুয়েটের পাঁচজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইতালির বিশ্বখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ড্যানিয়েলিতে প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁদের একজন শুভ রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে তিন বছর ওয়ালটনে চাকরি করেছি। তবে আমার স্বপ্ন ছিল বিশ্বের নামকরা কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার। সায়েম স্যারের উদ্যোগে ইতালির বিখ্যাত স্টিল কোম্পানি ড্যানিয়েলি চুয়েটে প্রকৌশলী নিয়োগের জন্য আসে। আমি আবেদন করে লিখিত পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার পেরিয়ে চাকরির সুযোগ পাই। নিয়োগপ্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে, এমনকি ভিসা জটিলতা নিরসনেও স্যার আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। এখনো নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রাখেন। স্যারের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।’

প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক প্রসঞ্জীত দাশ। তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের এমন জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে, যেখানে তারা আন্তর্জাতিক কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে পারে এবং চুয়েটের নামকে গর্বের সঙ্গে বহন করতে পারে। ঠিক সেই কাজটিই করেছেন অধ্যাপক সায়েম। তিনি ড্যানিয়েলির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের চুয়েটে নিয়ে আসেন। তারা বাংলাদেশে প্রথম শুধু চুয়েট থেকেই ৫ জন শিক্ষার্থীকে প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা প্রমাণের বড় সুযোগ।’

অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম নিজেও চুয়েট স্নাতক। ২০০৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে জাপানের হোক্কাইডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং অস্ট্রেলিয়ার সিকিউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। পিএইচডি শেষে অস্ট্রেলিয়ার খ্যাতনামা মাইনিং কোম্পানি এমিরান্ডে মেকানিক্যাল ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ভিনদেশের বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন। অধ্যাপক সায়েম বলেন, ‘বিদেশে থেকে হয়তো নিজের জন্য অনেক কিছু অর্জন করা যেত। কিন্তু আমার অর্জন যদি শিক্ষার্থীদের কাজে না লাগে, যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে প্রকৌশলীর পরিচয় দিয়েছে, তার জন্য যদি কিছু করতে না পারি, তাহলে এসবের মূল্য কী? তাই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি, বিশ্বমঞ্চে চুয়েটের নাম ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই।’

আরও পড়ুন