ইউএপির প্রায় ৩০ বছর হলো। এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন কী? এই পথচলাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অধ্যাপক কামরুল আহসান: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯৯৬ সালে। মাত্র তিনজন ছাত্র নিয়ে শুরু করেছিলাম। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা আজ প্রায় সাত হাজার। শুরু থেকেই আমাদের স্লোগান ছিল ‘কমিটেড টু এক্সিলেন্স’। অর্থাৎ আমরা উৎকর্ষ সাধনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু কীসের উৎকর্ষ? উত্তর—জ্ঞানের। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী পদচিহ্ন রাখতে পারাটাই আমাদের বড় অর্জন। এ ধরনের মানসম্মত শিক্ষা দেশে এখন বিশেষভাবে দরকার। ৩০ বছর ধরে গুণগত শিক্ষাব্যবস্থা বিনির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বেশ কিছু জায়গায় লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেই ইউএপি কাজের স্বীকৃতি পেয়েছে।
আমরা দেখেছি, ইউএপি সব সময়ই বড় বড় আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায়। হোক সেটি জাতীয় পর্যায়ের রোবোটিকস অলিম্পিয়াড, কিংবা আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা (এসিএম, আইসিপিসি)। এর পেছনে কি বিশেষ কোনো ‘ভিশন’ আছে?
অধ্যাপক কামরুল আহসান: আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে; কিন্তু কতটা ভালো তা প্রমাণ করতে দরকার অন্যদের সঙ্গে তুলনা করার কার্যকর ব্যবস্থা। সেটিই প্রতিযোগিতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গুণগত মান যাচাই করা যায়। এখন তো বিশ্বজুড়েই আয়োজন করা হয় গণিত, রোবোটিকস, প্রোগ্রামিংসহ বিভিন্ন অলিম্পিয়াড। গর্বের বিষয়, বাংলাদেশে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইউএপি ২০২২ সালে ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্ট (আইসিপিসি) ‘৪৫তম আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস ঢাকা-২০২২’ আয়োজন করেছিল। একে প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বকাপও বলা হয়। আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে বেশ ভালো করেছে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উৎসাহ ও প্রেরণা পায়। পাশাপাশি জ্ঞান, দক্ষতা ও সক্ষমতার পরীক্ষা দিয়ে নিজের অবস্থান জানতে পারে।
কর্মদক্ষতা তৈরি মানেই কেবল চাকরির প্রস্তুতি নয়; বরং উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহও তৈরি করা দরকার। আমি কী জানি, তার থেকেও বড় কথা আমি কী পারি। শিক্ষার্থীদের ভেতরে এই মন্ত্রটা ছড়িয়ে দিতে চাই।
ইউএপির অনেক অ্যালামনাই বর্তমানে দেশে-বিদেশে ভালো অবস্থানে আছেন। এই শক্তিশালী অ্যালামনাই নেটওয়ার্ককে কাজে লাগাতে আপনারা কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?
অধ্যাপক কামরুল আহসান: শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, উভয়ের সঙ্গেই অ্যালামনাইরা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সবাই জানে, শুধু ডিগ্রি দিয়ে এখন চাকরি হয় না। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও করতে হয় যুগোপযোগী বাড়তি কোর্স, অর্জন করতে হয় দক্ষতা। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য অ্যালামনাইরা বিনা মূল্যেই এসব সার্টিফায়েড কোর্স আয়োজন করে। এ ছাড়া আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিখনপদ্ধতি, পাঠ্যসূচি ইত্যাদি সম্পর্কে তারা নিয়মিত আমাদের মতামত দেয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কীভাবে কোর্স সাজানো উচিত, সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।
বলা হচ্ছে, এআই পৃথিবীকে অনেক দ্রুত বদলে দেবে। পৃথিবী যেভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে, আপনাদের পাঠ্যক্রমও কি সেভাবে বদলানো প্রয়োজন? এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন?
অধ্যাপক কামরুল আহসান: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বর্তমানে খুব শক্তিশালী অস্ত্র। এটিকে ব্যবহার করতে হবে নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। যেমন গুগল আমাদের শিক্ষা ও গবেষণায় রেখেছিল বড় ভূমিকা। আমরাও সেটি ব্যবহার করেছি দায়িত্ব নিয়ে। একইভাবে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সচেতন হতে হবে। আমার দৃষ্টিতে, এআই কখনোই মানুষের শিক্ষক হতে পারবে না; বরং মানুষকেই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এআই সহায়ক তথ্য দেবে, নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবতে উৎসাহ জোগাবে, চিন্তাশক্তি বাড়াবে। তবে উদ্ভাবন কেবল মানুষই করতে পারবে; এআই কোনো দিন মানুষের সৃজনশীলতা বা আবিষ্কারকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।
এআই কিন্তু শুধু বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির জন্য সীমাবদ্ধ নয়। মানবিক ও ব্যবসাতেও এর ব্যবহার দরকার। আমার মতে, পাঠ্যসূচিতে স্টেম শিক্ষাও (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) অন্তর্ভুক্ত করা সমানভাবে জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, ল্যাব ওয়ার্ক, ক্লাব ও সফট-স্কিল কার্যক্রমের সঙ্গে এআই যুক্ত করার চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য, শিক্ষার্থীরা যেন ভবিষ্যতে বলতে পারে, ‘আমি এআই ব্যবহার করতে জানি এবং আমি একে নিয়ন্ত্রণ করি।’
এ মুহূর্তে ইউএপি কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে
অধ্যাপক কামরুল আহসান: বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এর বাইরে নয়। তবে অন্যকে প্রতিপক্ষ ভেবে নয়, বরং সক্ষমতা দেখে নিজেদের উন্নত করার মানসিকতা থাকা জরুরি। আমরা অনুধাবন করেছি, নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষায় ক্যাপস্টন প্রকল্পের মতো কার্যক্রম যুক্ত করতে হবে। এটি শিক্ষার্থীদের জটিলভাবে ভাবতে ও উদ্ভাবনী দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে। কর্মদক্ষতা তৈরি মানেই কেবল চাকরির প্রস্তুতি নয়; বরং উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহও তৈরি করা দরকার। আমি কী জানি, তার থেকেও বড় কথা আমি কী পারি। শিক্ষার্থীদের ভেতরে এই মন্ত্রটা ছড়িয়ে দিতে চাই।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় আসলে একটি গবেষণা কারখানা। গবেষণা লালন না করলে শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে নেওয়া কঠিন। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করতে হলে পিএইচডি ও পোস্ট-ডক প্রোগ্রাম চালু করা জরুরি। ইউএপির অনেক বিভাগ ইতিমধ্যেই এ ধরনের সক্ষমতা অর্জন করেছে, তাই অনুমোদনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়া উচিত।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিকীকরণে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার। ইউএপি ইতিমধ্যে অ্যাসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ, অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটিজের সদস্য হয়েছে। একলা চলার নীতি থেকে বেরিয়ে সহযোগিতা ও জ্ঞান ভাগাভাগির মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়—শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, দেশি-বিদেশি সহযোগিতা ও সমঝোতা (এমওইউ) এবং গবেষণার প্রসার ঘটানো।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে ইউএপি কী উদ্যোগ নিচ্ছে? আপনাদের গবেষণা কি সরাসরি আমাদের দেশে বা সমাজে প্রভাব ফেলতে পারছে?
অধ্যাপক কামরুল আহসান: ইউএপির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গবেষণায় উৎসাহ দিতে নিয়মিত বরাদ্দ দেওয়া হয়। গবেষণা সহকারী (আরএ) বা শিক্ষকের সহকারী (টিএ) হিসেবেও শিক্ষার্থীরা গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিয়ে আমাদের কাজ করার সময় এসেছে। অর্থাৎ, প্রশ্ন করতে হবে, আমরা যে গবেষণাটি করছি, সেটা কি সর্বোপরি এসডিজির আওতায় পড়ছে কি না। এসব বিষয়েও আমাদের নজর আছে।
ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ইউএপি কীভাবে যোগাযোগ রাখছে?
অধ্যাপক কামরুল আহসান: এটা এখন বহুল আলোচিত বিষয়। ‘ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমি’ নামের এই সম্পর্ক আমি অন্যভাবে দেখি। শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে, এমনটা নয়; বরং আমার মনে হয়, শিক্ষকই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। আমার নিজেরই স্যামসাংয়ে প্রকৌশলী হিসেবে পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তখন প্রশিক্ষণও পেয়েছি। আমাদের দেশে অধ্যাপক হয়েও প্রশিক্ষণে গেলে অনেকে অবাক হন। অথচ উপাচার্যদেরও শেখার প্রয়োজন থাকতে পারে। কেউ তো সবকিছু জেনে ফেলতে পারে না। তাই আমাদের এ ব্যাপারে কাজ করার ইচ্ছা আছে। বাইরে থেকে ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে আমরা শিক্ষকেরা কতটুকুই–বা জানি। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে সেই ঘাটতি পূরণ করা দরকার। ‘ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমি’ সম্পর্ক ভালো হলে তাদের বড় প্রকল্পে আমাদের শিক্ষার্থীরাও ইনপুট দেবে। চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ও স্নাতক তৈরিতে প্রস্তুতি নিতে পারবে।
আরেকটি উদাহরণ দিই। দেশে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা বেশ ভালো। বৈশ্বিক এই বাজার ধরতে দক্ষ লোক প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রয়োজনীয়তা জানায়, সে অনুযায়ী আমরা স্নাতক তৈরি করতে পারব। এতে দুই পক্ষেরই লাভ। ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে।
এ সময়ের কিশোর-তরুণদের জন্য যদি তিনটি পরামর্শ দিতে বলা হয়, কী বলবেন?
অধ্যাপক কামরুল আহসান: প্রথম পরামর্শ—স্বপ্ন দেখতে শেখা। কারণ, স্বপ্ন থেকেই বড় বড় উদ্ভাবন এসেছে। তবে শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না, স্বপ্ন দেখার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্রও তৈরি থাকতে হবে। যে যেমন পরিবেশ পায়, তার স্বপ্নও তেমন হয়। তাই প্রতিকূল সময়েও ইতিবাচক স্বপ্ন দেখার মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার। কারণ, উদ্ভাবন আর অগ্রগতির জন্য এটা অপরিহার্য।
দ্বিতীয় পরামর্শ—আজীবন শেখার অভ্যাস। অনেক সময় অল্প পড়েই আমরা ভাবি, অনেক জেনে ফেলেছি। আদতে কিন্তু শেখার শেষ নেই। জ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রতিদিন বদলাচ্ছে। নতুন কিছু শিখতে না পারলে দ্রুত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইউটিউব ভিডিও বা কয়েকটি কনটেন্ট দেখেও শেখা যায়; কিন্তু সত্যিকারের জ্ঞান অর্জনের জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। আমি নিজেও সব সময় এই অভ্যাস চর্চা করি।
তৃতীয় পরামর্শ—শক্ত নেটওয়ার্ক তৈরি করা। ফেসবুকে শুধু বন্ধু বাড়ানো নয়। গবেষণার প্ল্যাটফর্ম, পেশাদার নেটওয়ার্ক কিংবা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পর্কও তৈরির চেষ্টা থাকতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক মানের নেটওয়ার্ক তরুণদের দক্ষতা, সুযোগ ও স্বীকৃতি এনে দেয়। আমি নিজেও যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছি। এর ফলে আজও আমি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাই।