অক্টোবর এলেই ছোটবেলার যে কথাগুলো মনে পড়ে
পুব আকাশে তখনো ঠিকমতো আলো ফোটেনি। আশ্বিনের হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়া প্রিয় নগরবাড়ি। গ্রামজুড়েই শীতল একটা আবেশ। দেবী দুর্গার আগমনী বার্তায় উৎসবমুখর চারপাশ। মায়ের হাতে বোনা নকশিকাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছি। সেই মুহূর্তে শিওরের জানালায় টোকা! এক, দুই, তিন! কবাট খুলতেই ওপাশে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ—আমার বন্ধু। মুখে অমলিন হাসি আর হাতে ফুল তোলার সাজি। বলে, চল যাই।
আগের দিন পঞ্চমীর রাতে কুটিকাকার মণ্ডপে মা দুর্গার চোখ আঁকা হয়েছে। অপূর্ব সেই ঘটনার সাক্ষী হতে গভীর রাত পর্যন্ত সবাই মন্দিরে ছিলাম। বিনয় পাল যখন রং-তুলির আঁচড়ে মায়ের চক্ষুদান করেন, তখন উলু আর শঙ্খধ্বনিতে চারপাশে তৈরি হয় মোহনীয় এক পরিবেশ। মনে হয়, এই মা যেন আমাদের খুব কাছের, খুব আপন।
কথিত আছে ষষ্ঠী থেকে দশমী—এই পাঁচ দিনের জন্য কৈলাস থেকে মর্ত্যে বাবার বাড়ি আসেন উমা তথা মা দুর্গা। সঙ্গে আসেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক।
কাল দেবীর বোধন হয়েছে। আজ মহাষষ্ঠী। মায়ের পূজা শুরু। আর পূজার অবিচ্ছেদ্য উপাদান হচ্ছে ফুল। আমাকে আর কৃষ্ণকে পূজার ফুল তোলার দায়িত্ব দিয়েছেন কুটিকাকা। তাই সাতসকালেই এত তাড়া। ঝটপট তৈরি হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি।
প্রথমে আমরা যাই শিউলিতলা। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই গাছটি; আমার ঠাকুরমার হাতে লাগানো। আলো-অন্ধকারেও দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সাদা শিউলিতে ছেয়ে আছে গাছতলাটা।
কী তার সৌরভ! গ্রামে বেড়ে ওঠা অনেকের কাছেই অক্টোবর মানে শিউলির ঘ্রাণ, গাছের পাতায় জমা বিন্দু বিন্দু শিশিরকণা আর হালকা শীতের শিরশিরে হাওয়া।
শিউলি কুড়িয়ে ঝুড়িতে তুলতে থাকি। বাতাসে গাছ থেকে শিউলি ফুলগুলো পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে আর আমরা সেগুলোকে টপাটপ সাজিতে তুলি। শিবু, অনির্বাণরাও এসে হাত লাগায়। এরপর অপরাজিতা, নয়নতারা, সন্ধ্যামালতী, গন্ধরাজ, জবা, বেলি, টগর ফুলে ভরে ওঠে আমাদের পূজার সাজি। এবার চাই বেলপাতা।
কিন্তু গাছটা অনেক উঁচু। আমাদের নাগালের বাইরে। তখনই আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা ছেলে আহমেদের সঙ্গে দেখা। বললাম, ‘পূজার জন্য বেলপাতা পেড়ে দে।’ লাফিয়ে বেলগাছে উঠে পড়ে আহমেদ।
মস্ত একটা পাতাসহ ডাল ভেঙে নেমে আসে, মুখে বিজয়ীর হাসি। বললাম, ‘নদীতে আসিস, একসঙ্গে স্নান করব।’ আহমেদ হেসে বলল, ‘নাড়ু আনিস।’ আচ্ছা বলতেই ওর অনুরোধ, ‘একটু বেশি করে কিন্তু।’
পাবনা জেলায় আমাদের গ্রামের শেষটা জুড়ে কেবল যমুনা নদী। আমাদের শৈশব-কৈশোরের সঙ্গী। শরতে যখন নদীর জল শুকিয়ে আসে, তখন তার বুকে জন্মে বিশাল কাশবন। হাওয়ায় হাওয়ায় সেই কাশফুলের কী অপূর্ব নৃত্য।
শেষ বিকেলে সূর্যের আলো যখন কাশফুলে পড়ে, চারপাশে তৈরি হয় এক মোহনীয় আবেশ। এসে মনে হয়, এসব ছোট ছোট উপলক্ষের জন্যই তো জীবন এত সুন্দর।
মাত্র আধা মাইল সীমার মধ্যে সাত-সাতটি পূজা হয় আমাদের গ্রামে। আলোকসজ্জা প্যান্ডেল হয় দেখার মতো। ধর্ম-জাতি-বর্ণনির্বিশেষে আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সর্বজনীন এই উৎসবকে সফল করি।
শত শত বছর ধরে এটাই হয়ে আসছে। আমরা সবাই একই গাঁয়ে থাকি, এটাই আমাদের একমাত্র পরিচয়।
সময়ের আবর্তে একসময় পূজার ঘণ্টা বাজে, পুরোহিত ঠাকুর মন্ত্র উচ্চারণ করেন, ঢাকঢোল-কাঁসর বাজে। ধূপ-ধুনুচির মিষ্টি গন্ধে পূজা পূজা আবেশ ছড়ায়; আমাদের রোমকূপ পর্যন্ত আন্দোলিত হয়। বাঙালি সনাতনীদের জন্য এ এক অন্য রকমের আবেগ। সারা বছর যার জন্য অপেক্ষা, তিনি এসেছেন।
মায়ের চেয়ে কে আর তাঁর সন্তানকে ভালোবাসবে? তাই মায়ের আগমনে কেবল বস্তুগত প্রাপ্তিই ঘটে না, আসে আত্মিক প্রশান্তি। ঠিক যেমনটা শিশু বোধ করে মাকে পাশে পেয়ে। ৮০ বছরের বৃদ্ধাও তাঁর মাকে ফিরে পান এই পাঁচটি দিন। তাঁর চোখজুড়ে নামে প্রাপ্তির অশ্রুধারা।
যাঁর যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী পোশাক পরে মাকে স্বাগত জানাতে চেষ্টা করেন মানুষ। মহাসপ্তমীর পূজা শেষে আসে মহাষ্টমী; অষ্টমীতে মাকে কুমারীরূপে পূজা করা হয়। দেওয়া হয় অঞ্জলি। মানুষ তার মনের চাওয়াগুলো অকপটে মায়ের কাছে উপস্থাপন করে। তারপর হয় সন্ধিপূজা। অষ্টমীর পূজা শেষে হয় ভোগের প্রসাদ বিতরণ। খিচুড়ি, পায়েস, সন্দেশ, নাড়ু, মোয়া-মুড়কি খেয়ে বন্ধু আহমেদ, ইমদাদ, পলাশ, কালাম, শিকদার তখন বেজায় খুশি।
সন্ধ্যায় ঢাকের তালে কোমর দোলানোর পালা। তাতে তাল-লয়ের সামঞ্জস্য না থাকলেও আনন্দের কোনো কমতি থাকে না। নির্মল এক বিনোদন শেষে আমরা সব বন্ধু যমুনার পাড়ে গিয়ে বসি। দূরে মণ্ডপ থেকে ভেসে আসে ঢাকঢোলের শব্দ। নদীর শীতল বাতাস আর আমাদের আড্ডা পূজার রাতটাকে করে তোলে আরও আনন্দময়।
সময়ের আবর্তে নবমীর পরে আসে দশমী। চারদিকে বিজয়ার সূর। পূজা শেষে সিঁদুর খেলা আর মিষ্টি বিতরণ আর মায়ের আশীর্বাদ নেওয়া, তারপর নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে মাকে যমুনায় নিয়ে যাওয়া।
প্রত্যেক সনাতনী বিশ্বাস করেন, ‘আমাদের দুঃখ নাশ করে কৈলাসে নিজের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন মা।’ বিসর্জন শেষে ফাঁকা মণ্ডপ দেখে বুকের ভেতর থেকে উগরে আসা কষ্টকে হজম করার নামই সংযম। সব আয়োজন শেষে মধ্যরাতে বিছানায় পাশ ফিরে মায়ের জন্য মন কেমন করা সন্তানেরাই হাসিমুখে বলে, ‘আসছে বছর আবার হবে।’