আমার চাইতে বয়সে কত বড় বড় মানুষের মা আছে, আমার নেই কেন?

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

মায়ের সঙ্গে কেয়া দেবনাথছবি: সংগৃহীত

মা নেই আজ চার বছর। তারপরও জীবন থেমে নেই।

মনে আছে, মায়ের শ্রাদ্ধের চার অথবা পাঁচ দিন পর আইইএলটিএস পরীক্ষায় বসেছি। মন দিয়ে দাগাচ্ছি উত্তর, আচমকা সব ঝাপসা হয়ে গেল। অক্ষরগুলোর মধ্যে ভেসে উঠল—মা। যতবার চাই মা চলে গিয়ে জটিল শব্দগুলো ফিরে আসুক, মা আর যায় না! তারপর থেকে যতবার সুন্দর কোনো বই পড়তে শুরু করেছি, সমুদ্রের নীল জলে পা ভেজানোর চেষ্টা করেছি, কলোরাডোর শরতের রঙে কিংবা শিকাগোর ঝকঝকে নীলাকাশে হারিয়ে যেতে চেয়েছি, মা ফিরে এসেছেন বারবার। পরিপাটি চেহারা নিয়ে নয়, ফিরে এসেছেন রোজকার সাধারণ বেশে।

লাকড়ির চুলার গনগনে লাল আলোয় ঘামে ভেজা আটপৌরে শাড়ি পরা মা আমার, চোখের জলে, ঘামে ভিজে একাকার হয়ে একের পর এক শুকনো খড়ি দিয়ে যাচ্ছেন চুলায়। ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশিবার দেখা এ চেহারাটাই সবকিছু ছাপিয়ে উঁকি মারে মাথায়।

পড়ার ফাঁকে রান্নাঘরে দেখতে গিয়ে জানতে চাইতাম, কেন কাঁদেন মা?

‘কই, কাঁদি না তো,’ আলগোছে জবাব দিতেন।

চেপে ধরলে বলতেন, ‘মা-বাবা নেই, বাপের বাড়ি বলতে কিছু নেই, এ কষ্টের তোরা বুঝবি কী?’

আরও পড়ুন

মা কি অন্য ভুবন থেকে জানেন, সেই অনুভূতিটা তাঁর মেয়েরা এখন জীবন দিয়ে বোঝে!

মা চলে যাওয়ার পর এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার, ভূমি) হলাম। পৃথিবীজুড়ে তখন কোভিড মহামারি। গ্রামে গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে লকডাউন করতে যেতাম। গাড়িতে বসে গ্রামের কোনো বাড়ির উঠান কিংবা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মধ্যবয়স্ক নারীকে দেখলেই মনে হতো এই বুঝি আমার মা। প্রতিমুহূর্তে আটপৌরে শাঁখা পরা কিংবা না পরা কাউকে হুট করে মা ভাবার অসহনীয় কষ্ট থেকে বাঁচতে প্লে-লিস্টে সফট মেলোডি, রবীন্দ্র-নজরুল বাদ দিয়ে জায়গা নিল সিয়া আর শাকিরা। হেভি মেটাল গান আর চোখে কাজল ঠোঁটে রং আরেক পরত গাঢ় করে দিয়ে নিজের কাছে লুকাতাম মা হারানোর কষ্ট।

দিনের পর দিন হেসেছি, সেজেছি, অন্যের প্রশংসায় ভেসেছি, সমালোচনায়ও অংশ নিয়েছি। হেন কোনো কাজ করিনি মা না থাকায় যা বাদ পড়েছে। জীবনের কোনো কিছু, কোনো উদ্‌যাপন বাদ পড়েনি মা আপনি না থাকায়। হাসির শব্দ কমেনি, বিনয় বাড়েনি, অহংকার কমেনি। সব আগের মতো আছে, মা। কেউ চলে গেলে এই পৃথিবীর কিছুই হয় না। জীবনে শুধু যোগ হয় এক বুক হাহাকার, শূন্যতা আর ক্ষণিকের তরে গুমরে ওঠা অসময়ী কান্না।

আরও পড়ুন

ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মোটিভেশনাল রাইটিং পার্ট লিখতে বসে ভাবছিলাম, নিজের কোন গল্পটা লিখব! ছোট থেকে বড় হওয়ার পুরো ভ্রমণটুকু লেখার মধ্যে লিখলাম, মাকে হারিয়ে প্রতি সকালে ঘুম ভেঙে আয়নায় নিজেকে প্রশ্ন করতাম, বাকি জীবন কী করে কাটাব?

একদিন আয়নায় উত্তর ভেসে উঠল, ‘গো ফর এক্সিলেন্স’।

আপনি সারা জীবন বলেছেন, ‘পড়াশোনা ছাড়া তোমাদের কাছে আমি আর কিছুই চাই না। মেয়ে হয়ে জন্মেছ, তোমাদের আয় করা পয়সায় আমাদের জীবন চলবে, সে আশাও আমরা করি না। বুড়ো হয়ে গেলে কোনো এক বৃদ্ধাশ্রমে আমরা চলে যাব।’

কী সৌভাগ্য আপনার মা, কোনো বৃদ্ধাশ্রমে আপনাকে যেতে হয়নি। কিন্তু এই দীর্ঘ জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পাওয়া না-পাওয়ার হাসি-কান্না ভাগ করার মানুষ যে আর কেউ রইল না, মা। আর কটা দিন পর গেলে কী এমন ক্ষতি হতো! মাঝেমধ্যে অদেখা ঈশ্বরের প্রতি খুব রাগ হয়। আমার চাইতে বয়সে কত বড় বড় বয়সের মানুষের মা আছে। আমার কেন নেই? কী এমন অপরাধ করেছি যে এত তাড়াতাড়ি মাকে হারাতে হলো। সবাই বলে মা নাকি সব দেখতে পান। সত্যিই কি দেখতে পান, মা? দেখতে পান কি, কী আকুল হয়ে অপেক্ষায় থাকি একটু ধরব বলে, দেখব বলে, মা!