ফাইনালে আশা জাগিয়ে কোন রাউন্ডে বাদ পড়লেন মিথিলা

আজ ২১ নভেম্বর মিস ইউনিভার্স ২০২৫–এর মুকুট উঠল মেক্সিকোর ফাতিমা বশের মাথায়। ১২০টি দেশের মধ্য থেকে সেরা ৩০ ঘোষণা করা হয় আজ বাংলাদেশ সময় সকাল পৌনে সাতটায়। আর সেখানে প্রথমবারের মতো সেরা ৩০–এর তালিকায় ঢুকে ইতিহাস গড়েন মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ তানজিয়া জামান মিথিলা। বাংলাদেশিরাও তাই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ইউটিউবে মিস ইউভার্স চ্যানেলে লাইভ চলাকালে প্রচুর বাংলাদেশি দর্শক সেখানে কমেন্ট করতে থাকেন দেশের নাম লিখে। কেউ পোস্ট করতে থাকেন লাল–সবুজ পতাকার স্টিকার। সবার আশা ছিল, হয়তো আরও বড় খবর আসতে পারে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাদ পড়েন মিথিলা। সেরার মঞ্চ থেকে ঠিক কোন রাউন্ডে বাদ পড়লেন তিনি?

ফাইনাল রাউন্ডের জন্য সেরা ৩০ ঘোষণার সময় মঞ্চে বাংলাদেশের তানজিয়া জামান মিথিলাছবি: ফেসবুক থেকে

থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত মিস ইউনিভার্সের ৭৪তম আসরে বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি মডেল ও অভিনেত্রী তানজিয়া জামান মিথিলা। মঞ্চে মিথিলা যাওয়ার আগপর্যন্ত বাংলাদেশকে অনেকে ‘দুধভাত’ হিসেবেই ধরেছিল। বিউটি প্যাজেন্ট নিয়মিত অনুসরণ করা বিদেশি ইনফ্লুয়েন্সার ও সাংবাদিকদের মুখে এমন কথা অনেকবার শোনা গেছে।

তবে দৃশ্যপট ধীরে ধীরে বদলে যায় ২ নভেম্বর মিথিলা মিস ইউনিভার্সের অনুষ্ঠানস্থলে পা রাখার পর থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা যখন আসতে থাকেন, তাঁদের ভিড়ে প্রথম দিন থেকেই বিশেষভাবে নজর কাড়তে শুরু করেন মিথিলা।

তাঁর পোশাক, সাজ, গয়না থেকে চলনবলন সবই ছিল আকর্ষণীয়। মিস ইউনিভার্সের ভেন্যুতে যাওয়ার আগে মিথিলা সপ্তাহখানেক নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নেন ফিলিপাইনের এক কোচের কাছে। যদিও সময়টা একেবারে কম, তারপরও যে কোচের কাছে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাতে নিজের কিছু দিক উন্নত হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন মিথিলা।

মিস ইউনিভার্সের ইনঅগারেশন সেরিমনি থেকে টিভি ইন্টারভিউ—সবখানেই আলোচনায় আসেন মিথিলা। নজর কাড়েন প্রতিবেলার পোশাকেও। দেশ ছাড়ার আগে মিথিলা মোট ৮টি বড় আকারের লাগেজ ভর্তি করে নিয়েছিলেন দরকারি জিনিসপত্র।

মিস ইউনিভার্স চলাকালে মিথিলা জানান, এখানে নিজের লাগেজ ভালোভাবে গুছিয়ে রাখাটাও একটা বিশেষ গুণ হিসেবে ধরা হয়। কারণ, যেহেতু প্রতিযোগীদের মিনিটে মিনিটে সাজপোশাক বদলাতে হয়, তাই প্রতিদিনের হিসাব করে সবকিছু গুছিয়ে রাখাও জরুরি।

আরও পড়ুন

থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে প্রতিযোগীদের গ্রুমিং ও ঘোরাফেরা ছাড়াও চলতে থাকে অলিখিত মার্কিং। তবে সবখানেই মিথিলা আলোচনায় উঠে আসেন শক্ত প্রতিযোগী হিসেবে।

অনলাইনে ভোটিং পর্ব শুরু হলে আলোচনা আরও বেড়ে যায়। এরপর মিস ইউনিভার্স আয়োজকেরাও বিশেষভাবে নজর রাখতে শুরু করেন মিথিলার দিকে। মানুষ নিয়মিত ভোট দিয়ে বিভিন্ন রাউন্ডে এগিয়ে রাখেন মিথিলাকে। অনলাইনে মিথিলা দর্শকের ভোট যেমন পেয়েছেন, সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন। কেউ কেউ মিথিলার প্রায় পাঁচ বছরের পুরোনো একটি ভিডিওর প্রসঙ্গ সামনে এনে তাঁর সমালোচনা করতে থাকেন।

এরপর পাতায়া শহরে অনুষ্ঠিত একটি পর্বে মিথিলা সুইমিং কস্টিউম পরলেও অনলাইনে নেতিবাচক কমেন্ট করেন কেউ কেউ। সেসব দেখে মিথিলা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। থাইল্যান্ড থেকে ফেসবুক লাইভে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মিথিলা বলেন, ‘আমি দেশের নাম উজ্জ্বল করতে এত পরিশ্রম করছি; তারপরও কিছু মানুষ নেগেটিভ কমেন্ট করছেন। আমিও তো একটা মানুষ, আমারও ইমোশন আছে। আপনারা নিজের দেশের লোক হয়েই যদি এভাবে নেগেটিভিটি ছড়ান, তাহলে আমি কোনোভাবেই সামনে এগোতে পারব না।’

তারপরও সেসব সমালোচনা সামলে ‘ক্লোজ ডোর ইন্টারভিউ’ সেশনে ভালো করেন মিথিলা। বিদেশি সাংবাদিকেরাও মিথিলার সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অনলাইনে সেসব ভিডিওতে বিদেশিরাও ‘স্ট্রং কন্টেস্ট্যান্ট’ হিসেবে মিথিলার নাম সামনে আনেন। অনলাইন ভোটিংয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও শেষ দিন মিথিলা জিততে পারেননি। তবে বিভিন্ন বিভাগে আলাদা ভোটে কোনোটায় প্রথম, কোনোটায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন। অনলাইন ভোটে যিনি সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন, তিনি সরাসরি সেরা ৩০–এ জায়গা করে নিতে পারেন।

মিথিলা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করলেও ফিলিপাইনের প্রতিযোগীর কাছে অনলাইন ভোটে হেরে যান। তবে সেরা ৩০–এ জায়গা করে নেন নিজ যোগ্যতায়। এই সেরা ৩০–এ জায়গায় করে নেওয়ার সময় মিথিলার নাম উচ্চারিত হয় দ্বাদশ প্রতিযোগী হিসেবে।

এর আগে ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত একাধিক পর্বে মঞ্চে ভালো করেন মিথিলা। ইভনিং গাউন, ন্যাশনাল কস্টিউম, বিকিনি রাউন্ডে ছিলেন স্বচ্ছন্দ।

আরও পড়ুন

২০ নভেম্বর সারা দিন ফাইনালের জন্য রিহার্সাল করেন ১৩০টি দেশের প্রতিযোগী। রাত ১২টায় রুমে ফিরে দুই ঘণ্টা ‘ন্যাপ’ নেওয়ার সময় পান মিথিলা। এরপর ২১ নভেম্বর রাত ৩টায় উঠে মেকআপ নিতে বসেন ফাইনালের জন্য। মেকআপ চলাকালে কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন। সেখানে ফাইনালের জন্য সবার কাছে দোয়া চান। মিথিলা বলেন, ‘আমি আমার সেরাটা দিয়ে লড়াই করেছি। বাকিটা ভোরেই বোঝা যাবে।’

এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টায় শুরু হয় মিস ইউনিভার্স ২০২৫–এর চূড়ান্ত পর্ব। সেখানেই সেরা ৩০ প্রতিযোগীর নাম ঘোষণা করেন উপস্থাপক। আর প্রথমবারের মতো বিশ্বের অন্যতম সেরা সুন্দরী প্রতিযোগিতা মিস ইউনিভার্সের ‘টপ থার্টি’ (সেরা ৩০) তালিকায় ঘোষণা হয় বাংলাদেশের নাম।

এই সেরা ৩০ জনকে নিয়েই হয় পরের পর্ব। যেখানে সুইমস্যুট পরে একে একে মঞ্চে হাঁটেন ৩০ প্রতিযোগী। বিচারকেরা সেই হাঁটা দেখে বাছাই করেন সেরা ১২। আর এখানেই হাঁটতে গিয়ে সামান্য হোঁচট খান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ভালোভাবে সামলে নিয়ে হাঁটা শেষ করেন মিথিলা। মিস ইউনিভার্সের নিয়মানুযায়ী, এসব ক্ষেত্রে ছোট্ট ভুল বা ছন্দপতনের কোনো সুযোগ নেই। ফলে একটা আশঙ্কা মাথায় উঁকি দেয়, ছোট্ট এই হোঁচটই কি মিথিলাকে সেরা ১২ থেকে ছিটকে ফেলল?

কিছুক্ষণ পর সেরা ১২ নাম ঘোষণার পর দেখা যায়, মিথিলা ছাড়াও ‘হেভিওয়েট’ প্রতিযোগীরাও একে একে অনেকে বাদ পড়ছেন। বাদ পড়াদের তালিকায় ছিলেন মিস ইউনিভার্স ইন্ডিয়া, মিস ইউনিভার্স ফ্রান্স, মিস ইউনিভার্স ব্রাজিল, মিস ইউনিভার্স যুক্তরাষ্ট্রও।

ফাইনালে মিস ইউনিভার্স ২০২৫ খেতাব জেতেন মেক্সিকোর ফাতিমা বশ। মুকুট, স্যাশে ও ফুলের তোড়া নিয়ে ছবি তোলার পর একে একে বাকি সব সুন্দরী মঞ্চে ওঠে আসেন। সেখানে মুকুটজয়ীকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানান তানজিয়া জামান মিথিলাও। ফাতিমার গাউনটি পেছনে অন্য একজনের পায়ের নিচ থেকে ছাড়িয়ে আনতেও সাহায্য করেন মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ।

বিজয়ীর সঙ্গে গাল মেলাচ্ছেন মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ মিথিলা
ছবি: ভিডিও থেকে

একাধিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার লাইসেন্স হোল্ডার, বাংলাদেশের ফ্যাশন অঙ্গনের প্রভাবশালী উদ্যোক্তা ও ন্যাশনাল ডিরেক্টর আজরা মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যতবার মিস ইউনিভার্সে গেছে, তার মধ্যে মিথিলার এই অর্জনই সেরা। সেরা ৩০ জনের মধ্য থেকে প্রতিযোগিতা শেষ করা বাংলাদেশের জন্যও দারুণ খবর। তবে এই পর্যায়ে যেতে মিথিলার যে হার্ড ওয়ার্ক ও ডেডিকেশন দেখেছি, তা অতুলনীয়। ওর সকাল হতো মিস ইউনিভার্স নিয়ে আর ঘুমাতেও যেতে মিস ইউনিভার্সের স্বপ্ন নিয়ে। কর্মই ওর ফল এনে দিয়েছে। আর বাংলাদেশের মানুষও মিথিলাকে দারুণ সাপোর্ট করেছে। এখন থেকে মিস ইউনিভার্স তো বটেই, অন্য সব সুন্দরী প্রতিযোগিতাতেও বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের স্ট্রং কন্টেস্ট্যান্ট হিসেবে বিবেচনা করবে।’

আরও পড়ুন