অজান্তেই সন্তানের মনে বিভেদের বীজ বুনছেন না তো

শিশুদের আমরা কী নিয়ে খেলতে দিচ্ছি, শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য তা খেয়াল করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মডেল: ইপশা, মনিরা আক্তার ও ভুবন গগণ
ছবি: কবির হোসেন

ঘটনা ১

গ্রামের মাঠে দাপিয়ে ফুটবল খেলছে অল্পবয়সী ছেলেরা। আমার সঙ্গে খেলা দেখতে এসেছে ৫ বছর বয়সী ভাইঝি রিমা। এমনিতে সে দারুণ চঞ্চল। লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি, দৌড়াদৌড়িতে ওস্তাদ। ওকে বললাম, ‘বড় হয়ে তুমিও কিন্তু মাঠে গিয়ে ও রকম খেলতে পারবে।’ রিমা বেশ জোর গলায় বলল, ‘না, পারব না। ফুটবল তো ছেলেদের খেলা। ওটা মেয়েরা খেলে না।’

ঘটনা ২

প্রতিবেশীর ছেলের জন্মদিন। খেলনার দোকানে উপহার কিনতে গেছি । সেলসম্যান এগিয়ে এলেন। ‘ছেলে বাচ্চার জন্য খেলনা কিনবেন? তাহলে এই যে দেখেন খেলনা গাড়ি, উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার, ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট...’

জানতে চাইলাম, মেয়ে বাচ্চাদের জন্য কী আছে?

হরেক রঙের ছোট–বড় পুতুল, হাঁড়িপাতিল, খেলনা ড্রেসিং টেবিল, সাজুনিগুজুনি দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।

প্রথমে ছেলেটার জন্য একটা লাল গাড়িই পছন্দ করলাম। পরে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, একটা এক্সপেরিমেন্ট করি না কেন? গাড়িটা রেখে একটা পুতুল আর এক সেট হাঁড়িপাতিল কিনলাম। খুব অবাক হয়ে জিনিসগুলো প্যাকেট করে দিলেন দোকানি।

অনুষ্ঠানের কয়েক দিন পর প্রতিবেশীর সঙ্গে লিফটে দেখা। একগাল হেসে বললেন, ‘আপনি বোধ হয় ভেবেছিলেন আমার মেয়ের জন্মদিন, তাই না?...উপহার দেখে বুঝলাম।’

‘কেন? আপনার ছেলে খেলনা পছন্দ করে নাই?’

‘ওসব তো মেয়েদের খেলনা, ছেলে কেন পছন্দ করবে? ওগুলো আমি মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি, ছেলেকে বলেছি, আন্টি হয়তো ভেবেছে তোমার বোনের জন্মদিন। হা হা হা।’

শিশুকালেই যেভাবে ঢোকে বিভেদ ও বৈষম্যের বিষ

জন্ম নেওয়ার পর মানবশিশু তার ছেলে বা মেয়ে পরিচয় সম্পর্কে সচেতন থাকে না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকীকরণ ও জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় শিশু পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। বুঝতে পারে নিজের লৈঙ্গিক পরিচিতি। মা–বাবা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা হয়তো সচেতনভাবে ছেলে ও মেয়েশিশুদের আলাদা করে দেখেন না, কিন্তু অবচেতনভাবে করা বিভিন্ন আচরণের মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজের অজান্তে স্পষ্টতই বৈষম্যের বীজ বুনে চলেন।

শিশুরা বেড়ে উঠুক সঠিক শিক্ষা নিয়ে
ছবি: কবির হোসেন

শিশুদের আমরা কী নিয়ে খেলতে দিচ্ছি, শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য তা খেয়াল করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত পুতুল আর রান্নাবান্না খেলতে খেলতে মেয়েশিশু শিখে যায় সমাজে তার জন্য নির্ধারিত ভূমিকা ঘরের ভেতর সংসার ও পরিবারের দেখাশোনা। অন্যদিকে ছেলেশিশু শেখে তার জগৎ ঘরের বাইরে, সে গাড়ি চালাবে, ক্রিকেট-ফুটবল খেলবে। বিশ্ব জয় করবে।

একটি শিশুর বেড়ে ওঠায় তার মা–বাবা, পরিবার ও পরিবেশের একটা বড় প্রভাব পড়ে। এমনকি আশপাশের মানুষজন ছেলে আর মেয়েশিশুর পার্থক্য নিয়ে অনবরত যেসব কথা বলে, সেসব কথাও শিশুর মনোজগতে স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। ছেলেমেয়েদের সামনে বাবা–মায়েরা প্রায়ই বলেন, ওটা ছেলেদের উপযোগী খেলা বা শক্তিতে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। কিংবা এগুলো মেয়েলি আচরণ আর ওসব পুরুষালি আচরণ।

মায়েদের প্রায়ই ক্রন্দনরত ছেলেশিশুকে থামানোর জন্য বলতে শোনা যায়, ‘ছেলেদের কাঁদতে হয় না, সবাই তোমাকে বোকা বলবে।’

কিংবা একটু ডানপিটে মেয়েকে থামাতে বলেন, ‘মেয়েদের এত লাফঝাঁপ মানায় না।’ কিংবা ‘মেয়েদের একটু সেজেগুজে থাকতে হয়। সাজলে তোমায় সুন্দর দেখায়। সবাই কত ভালো বলে। প্রশংসা করে।’

এমনকি শিশুদের পোশাকের রং নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিভাজন করি আমরা। মেয়েশিশুদের জন্য বেছে নিই কোমল রং, যেমন গোলাপি, হলুদ, লাল। আর ছেলেদের জন্য নিই কঠোর রং। নীল, ধূসর, কালো।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বড়দের বিভিন্ন কথোপকথন, আদেশ-নিষেধ এবং খেলনা বা পোশাকের মাধ্যমে পাঠানো এসব বার্তা শিশুর মস্তিষ্ক নিজের মতো করে গ্রহণ করে।

শিশুরাও কিন্তু তার চারপাশের মানুষদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে বুঝে নেয় কোন আচরণ তাদের জন্য উপযুক্ত। কী করা উচিত, কী নয়। এ ছাড়া একটা শিশু যখন দেখে যে মা একাই ঘরে কাজ করছে, সন্তান দেখাশোনা করছে আর বাবা বাইরে যাচ্ছে, ফিরে এসে দিব্যি আরাম করছে; তখন সে নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয় ছেলে বা মেয়ে হিসেবে তার করণীয় কী।

ধরুন, আমি চাই আমার মেয়েটি বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, কিন্তু তাকে খেলতে দিচ্ছি পুতুল আর ড্রেসিং টেবিল। অথবা আমি চাই যে আমার ছেলেটি হোক শান্তশিষ্ট, নম্র–ভদ্র, কিন্তু তার হাতে তুলে দিচ্ছি খেলনা পিস্তল বা বিধ্বংসী ভিডিও গেম।

আমাদের মেয়েরা যেমন এখন আর শুধু রান্নাবান্না বা ঘর সামলানো নিয়ে বসে নেই, বরং সব রকম চ্যালেঞ্জিং পেশাতেই দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, তেমনি অনেক সংবেদনশীল পুরুষও কিন্তু বাইরের কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজে হাত লাগিয়ে মা বা বউকে সাহায্য করছে। যদিও এই সংখ্যা খুবই কম।

বাস্তবতা এটাই যে এখনো কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা অর্জন করা যায়নি। বরং সব জায়গাতেই পুরুষের তুলনায় নারীরা সংখ্যায় কম। তেমনি আবার খুব কমসংখ্যক পুরুষই পরিবারে মা বা বউয়ের কাজে সাহায্য করে। যে ছেলেরা ঘরকন্নার কাজ করে, রান্না করে বা সন্তান প্রতিপালন করে, তাদের নিয়ে সমাজে ঠাট্টা–মশকরা করারও চল আছে।

ওই যে ছোটবেলায় মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, এইটা ছেলেদের কাজ, ওইটা মেয়েদের। পুতুল মেয়েদের খেলা আর গাড়ি ছেলেদের। রান্নাবান্না খেলবে মেয়েরা, ছেলেরা খেলবে ফুটবল। সমস্যাটা বেশির ভাগ সময় সেখান থেকেই তৈরি হয়।

মনস্তাত্ত্বিকেরা বলছেন, ‘ছেলেশিশুরা যদি এ রকম শুনতে শুনতে বড় হয় যে ছেলেরা শক্তিশালী, নারীরা দুর্বল; নারীকে হাতের মুঠোয় রাখা খুবই সহজ; কিংবা শিশু যদি দেখে বোনকে আঘাত করলেও সে কোনো শাস্তি পাচ্ছে না; যদি দেখে, মা–বোন পরিবারে নিগৃহীত হচ্ছে; তবে সেই শিশু বড় হয়ে মনের অজান্তেই অত্যাচারী ও নির্যাতক হয়ে উঠতে পারে। নারীর ওপর যেকোনো ধরনের সহিংসতা চালাতে সে দ্বিধা করে না। আবার মেয়েশিশুকে সারাক্ষণই যদি আদর করে ‘পুতুল সোনা’ ‘ফুটফুটে পরী’ বা ‘আদরের রাজকন্যা’ নামে ডাকা হয়, তখন স্বভাবতই নিজের চেহারা, সাজগোজ নিয়েই সে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে উঠতে পারে। নিজের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করার চেয়ে নিজেকে পুরুষের আকর্ষণের বস্তু হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

অর্থাৎ শিশু বয়সে নারী-পুরুষের অবস্থান নিয়ে মানুষের মনে যে ধারণা তৈরি হয়, তারই প্রতিফলন ঘটে পরবর্তী জীবনে, সংসারে ও ক্যারিয়ারে। সুতরাং নারী-পুরুষ সমতার পৃথিবী গড়তে চাইলে শিশুর বিকাশকে হালকাভাবে দেখার কোনো উপায় নেই। প্রচলিত প্রথা, ধারণা ও বিশ্বাসগুলো পরিবর্তনে কাজ করতে হবে গোড়া থেকেই। সচেতন হতে হবে নিজেদের কথা ও আচরণ নিয়ে।

শাহ্‌নাজ মুন্নী: সাংবাদিক ও লেখক