বেলস পালসি বা ফেশিয়াল পালসি—যে রোগে মুখ বেঁকে যায়
মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসা ৭ নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভের নাম ফেশিয়াল নার্ভ। এটি মুখের পেশির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই নার্ভ যদি কোনো কারণে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে প্যারালাইসিস হয়ে যায়, তবে তাকে বলে বেলস পালসি। স্কটিশ অ্যানাটমিস্ট চার্লস বেলের নামানুসারে রোগটির নাম দেওয়া হয়েছে বেলস পালসি।
এই রোগের মূল কারণ আজও অজানা। তবে কিছু কিছু ভাইরাস সংক্রমণ এ জন্য দায়ী বলে প্রমাণ মিলেছে। যেমন হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস ও হার্পিস জোস্টার ভাইরাস। এ ছাড়া সারকোডোসিস, লাইম ডিজিজের কারণেও হতে পারে বেলস পালসি।
এই ভাইরাসগুলো সাধারণত মৌসুমভিত্তিক আক্রমণ করে। শীতের পরে গরম অথবা গরমের পর শীতকালে মানে মৌসুম পরিবর্তনের সময় এসব ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির কাল। দেখা যায়, এই সময়গুলোতেই বেলস পালসি বেশি হয়।
বেলস পালসি দুই ধরনের হতে পারে। দুটো ধরনের কারণও ভিন্ন।
১. কপাল থেকে শুরু করে থুতনি মানে মুখের গোটা একটা পাশ যদি প্যারালাইসিস বা অবশ হয়ে পড়ে, তবে তাকে বলে লোয়ার মোটর নিউরন টাইপ অব ফেশিয়াল পালসি।
২. কপালের অংশ বাদে চোখ থেকে নিচের অংশ প্যারালাইসিস হলে সেটাকে বলে আপার মোটর নিউরন টাইপ অব ফেশিয়াল পালসি।
কী হয়
সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ হঠাৎ সকালে উঠে দেখতে পারেন যে তার মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে। চোখ একটা বন্ধ হচ্ছে, আরেকটা ঠিকমতো হচ্ছে না। কুলি করতে গেলে বা পানি খেতে গেলে পানি একদিকে পড়ে যাচ্ছে।
বেশির ভাগ মানুষ প্রথমেই মনে করেন স্ট্রোক করেছে। বেলস পালসির সঙ্গে স্ট্রোকের পার্থক্য হলো, স্ট্রোকে মুখ ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গ আক্রান্ত হয়। কোনো এক দিকের হাত–পাও অবশ হয়ে যায়, কখনো স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী অচেতন হয়ে পড়েন বা অসংলগ্ন কথা বলেন। বেলস পালসিতে এসব হয় না, বেলস পালসির প্রধান উপসর্গ মুখের যেকোনো একদিক বাঁকা হয়ে যাওয়া। ডান দিকে বেলস পালসি হলে মুখ বাঁ দিকে এবং বাঁ দিকে হলে ডান দিকে বাঁকা হবে। এক চোখ বন্ধ হলে অন্যটি বন্ধ হবে না। খাবার খেতে গেলে বেলস পালসিতে আক্রান্ত পাশের খাবার আটকে থাকবে। খাবার চিবিয়ে খেতে পারবে না, আটকে যাবে। কুলি করতে গেলে মুখের এক পাশ দিয়ে পানি বের হয়ে যাবে।
কেন হয়
আমাদের ব্রেনের ভেতর নিচ দিকে ব্রেন স্টেম নামের জায়গা থেকে ফেশিয়াল নার্ভের কোষ বা নিউরনের উৎপত্তি। ব্রেন থেকে বেরিয়ে একটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মুখে এসে পৌঁছায় ফেশিয়াল নার্ভ। এই পথপরিক্রমার নানা স্থানেই আক্রান্ত হতে পারে এই নার্ভ। ফেশিয়াল নার্ভ আক্রান্ত হলে মুখের পেশি আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও কেউ কেউ কানে বেশি শুনতে পায়। মেডিকেলের ভাষায় একে বলে হাইপারঅ্যাকিউসিস। কারণ, ফেশিয়াল নার্ভের সঙ্গে কানের নার্ভের যোগ আছে, তাই ফেশিয়াল নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে কানের নার্ভও আক্রান্ত হয়। ফেশিয়াল নার্ভের আরেকটি কাজ হলো জিবের কিছু কাজ নিয়ন্ত্রণ। তাই যে পাশের নার্ভ আক্রান্ত হয়, সেই পাশের জিবে স্বাদও একটু কম পাওয়া যায়।
চিকিৎসা
চিকিৎসাপদ্ধতি খুবই সহজ। চিকিৎসার দুটি ভাগ—মেডিকেল চিকিৎসা এবং ফিজিওথেরাপি।
ফেশিয়াল নার্ভের ফোলা ভাব বা প্রদাহ কমাতে স্বল্প মেয়াদে উচ্চমাত্রার প্রদাহরোধী ওষুধ স্টেরয়েড দেওয়া হয়। এতে দ্রুত উপসর্গ কমতে থাকে। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও ব্যবহার করা হয়। তবে মূল চিকিৎসা হচ্ছে ফিজিওথেরাপি। সঠিক পদ্ধতিতে ফিজিওথেরাপি আর সময়মতো স্টেরয়েডের স্বল্পমেয়াদি কোর্সে দুই–তিন সপ্তাহ বা এক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সেরে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে সময় একটু বেশি লাগতে পারে। তরুণেরা অপেক্ষাকৃত দ্রুত সুস্থ হয়। তবে ৯০ শতাংশ পুরোপুরি সুস্থ হলেও ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা থেকে যেতে পারে। যেমন মুখ কিছুটা বাঁকা থেকে যেতে পারে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ফিজিওথেরাপি দিতে পারলে বাঁকাভাবও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। সঠিক চিকিৎসা পেতে হলে অবশ্যই একজন রোগীকে নিউরোলজিস্টদের কাছে যেতে হবে।
প্রতিকার কী
এই ভাইরাস প্রতিরোধের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো থাকলে ভাইরাস সংক্রমণ কম হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একটু হলেও কমে। বেলস পালসির প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
১. ঠান্ডা ও ঠান্ডা বাতাস থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। ঠান্ডা বাতাস বা এসির সরাসরি সংস্পর্শে বেশি সময় থাকবেন না। রাতে ঘুমানোর সময় জানালা খোলা রাখলে ঠান্ডা বাতাসে স্নায়ু আক্রান্ত হতে পারে।
২. ভাইরাল সংক্রমণ প্রতিরোধ করুন। হার্পিস ভাইরাসসহ (HSV-1) বিভিন্ন ভাইরাস বেলস পালসির সঙ্গে জড়িত। ঠান্ডা, ফ্লু বা অন্য ভাইরাসজনিত অসুস্থতা হলে দ্রুত চিকিৎসা নিন।
৩. ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। কারণ, এই দুটি শারীরিক সমস্যা থাকলে বেলস পালসির ঝুঁকি বেশি থাকে।
৪. মুখে বা কানে ইনফেকশন হলে অবহেলা না করে চিকিৎসা নিন। কানের ইনফেকশন অনেক সময় স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করে।
জটিলতা কী
৫ শতাংশ মানুষের বেলস পালসির কিছু জটিলতা হতে পারে। মুখের এক অংশ কিছুটা দুর্বল থাকে। অনেক সময় ফেশিয়াল নার্ভের মূল নিউরন বেলস পালসিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে চোখ আক্রান্ত হয়। খাওয়ার সময় নার্ভের জটিলতার কারণে চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে। এই অদ্ভুত সমস্যার নাম ক্রোকোডাইল আই বা কুম্ভীরাশ্রু। কারও কারও ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে পারে।
অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতাল, আগারগাঁও, ঢাকা