আমার ছেলের বয়স ১৩ বছর, ওর উচ্চতা খুব একটা বাড়ছে না
ডায়েট, ব্যায়াম ও ওজন কমানো–বাড়ানো নিয়ে পাঠকদের নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান শামছুন্নাহার নাহিদ।
প্রশ্ন: আমার ছেলের বয়স ১৩ বছর। সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সব রকম মাংস খেতে ভালোবাসলেও সে মাছ ও সবজি খেতে চায় না। ওজন যে খুব একটা বেশি, তা–ও না। তবে এই বয়সে ওর ওজন স্বাভাবিক হলেও আমার মনে হচ্ছে উচ্চতা খুব একটা বাড়ছে না। এটা কি খাবারের কারণে? আমি ও আমার স্ত্রী একদম খাটো না (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি)। ছেলের এখন মুখে দাড়ি–গোঁফ দেখা দিচ্ছে, কণ্ঠস্বরেও পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ওর ডায়েটটা কেমন হওয়া উচিত জানতে চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: আপনার ছেলেকে নিয়ে প্রশ্ন অনেকগুলো—
আপনার মনে হয় বয়সের তুলনায় ছেলের উচ্চতা কম; কিন্তু আপনি ছেলের ওজন ও উচ্চতা জানাননি। তাই উচ্চতা আদৌ কম কি না, সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তারপরও আপনার জন্য জানাচ্ছি ছেলেদের উচ্চতা বাড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো ৯ থেকে ১৮ বছর, যাকে বলা হয় বয়ঃসন্ধিকাল। বয়ঃসন্ধিকালে উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য মূল বিষয় এইচজিএইচ (হিউম্যান গ্রোথ হরমোন)।
৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে, এরপর এই হরমোনের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। অন্যদিকে শরীরের দীর্ঘ হাড়ের প্রান্তের কাছে থাকে গ্রোথ প্লেট, যা উচ্চতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে একবার বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে গেলে এই বৃদ্ধির প্লেটগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং এই বন্ধ হয়ে গেলে এইচজিএইচ আর লম্বা করতে পারে না।
মানুষের শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধি মূলত ৩টি মূল বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেগুলো হলো ১. বংশগত/জিনগত, ২. শৈশবকালীন পুষ্টি/খাদ্যাভ্যাস ও ৩.শারীরিক পরিশ্রম।
বংশগত বা জিনগত
সন্তান মা–বাবা থেকে যে জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো পেয়ে থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে জন্মের পর তার পুষ্টি ও জীবনযাপনগত পরিবেশ। যেমন ধরুন আপনি মরুভূমি অঞ্চল থেকে খেজুরগাছ এনে লাগালেন, আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কি ওই গাছে একই পরিমাণ খেজুর ধরবে?
সঠিক খাদ্যাভ্যাস
দৈহিক উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুষম খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জন্মের পর থেকেই এটি দিতে হবে। তাই শিশুদের বয়স অনুপাতে লম্বা হওয়ার জন্য প্রতিদিন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার রাখতে হবে। কারণ, তা শরীরের চর্বি ও ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা অনুযায়ী এইচজিএইচের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। আবার প্রচুর পরিমাণে চর্বিযুক্ত প্রোটিন বিশেষ করে ট্রিপটোফ্যান ও মেলাটোনিন–সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, মটরশুঁটি, সয়া ও বাদামের মতো প্রোটিনজাতীয় খাবার খাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টি (কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, মিনারেল, তেল) আনুপাতিকহারে খেতে হবে, না হলে পর্যাপ্ত প্রোটিনজাতীয় খাবার খাওয়া সত্ত্বেও তা সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। আপনার ছেলের বয়সে (যেহেতু উচ্চতা কম) প্রতি কেজি ওজনের জন্য ২ গ্রাম করে (যেমন ওজন যদি ৪৫ কেজি হয়, তবে ৯০ গ্রাম) প্রোটিনজাতীয় খাবার খেতে হবে, মনে রাখবেন মাছ/মাংস/ডিম/দুধজাতীয় খাবারের ওজন এখানে গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হলো মাছ–মাংস থেকে আসা প্রোটিনের মাপ। এটি সঠিক হতে হবে। তার জন্য আপনার ছেলেকে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে হবে।
সুষম খাবারের পাশাপাশি ছেলেকে প্রতিদিন সূর্যরশ্মিতে যেতে হবে, তাতে করে এইচজিএইচ মাত্রা বাড়িয়ে পেশি এবং হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
আপনি বলেছেন ছেলে শাকসবজি খেতে চায় না, ফলে তার খাবারে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব রয়েছে। এ কারণে ওর মেটাবলিজম (বিপাকক্রিয়া) সঠিক মাত্রায় হয় না, ফলে ওর সার্বিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এটাও উচ্চতা কম হারে বাড়ার একটা কারণ। আপনি ধীরে ধীরে সবজির যে পদগুলো ছোটরাও পছন্দ করে (চায়নিজ সবজি, সবজির চপ, ভর্তা, মিক্স সবজি, ডাল-সবজি, শাকের পাকোড়া ইত্যাদি), সেগুলো ওকে খাওয়াতে শুরু করেন।
শারীরিক পরিশ্রম
উচ্চতা বাড়াতে চাইলে বাস্কেটবল, সাঁতার, দড়ি লাফ, ভলিবল ইত্যাদি ধরনের খেলা ও ব্যায়াম করা জরুরি।
আরও যা দরকার—
পর্যাপ্ত ঘুম
বয়ঃসন্ধিতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম (৮-৯ ঘণ্টা) দরকার। মাঝরাতের ঘুমের মধ্যে এইচজিএইচের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি থাকে; শরীর এই হরমোন তৈরি করে উচ্চতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
মানসিক চাপ
মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা হরমোন তৈরিতে বাধা তৈরি করে শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। তাই এই বয়সে মানসিক চাপমুক্ত হয়ে আনন্দে থাকতে হবে।
বসা-শোয়া ও দাঁড়ানোর ভঙ্গির কারণেও উচ্চতা কিছুটা পাল্টে যেতে পারে, যেমন ঝুঁকে দাঁড়ান বা হাঁটা যাবে না, কারণ দাঁড়ানো বা বসার ভঙ্গির কারণে আমাদের অনেকের মেরুদণ্ড, ঘাড়, কাঁধ সামনের দিকে ঝুঁকে যায়, ফলে উচ্চতা কম দেখায়। ছেলে নিয়মিত ঘাড়, কাঁধ, মেরুদণ্ডের স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করতে থাকুক।
পরিপূর্ণ ডায়েট চার্ট করে নিতে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে পারেন।