বুলিং নিয়ে কি আগের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার কিশোর–কিশোরীরা?
বছর আঠারোর এক চাচাতো ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী রে ‘অ্যাডলেসেন্স’ সিরিজটা দেখেছিস নাকি? তার উত্তর ‘ইয়াপ’। আমার সেই ভাই থাকে খুলনায়। সেখানকার একটি কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাস করেছে। মেসেঞ্জারে কথা এগোতে চাইলাম, তার খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। এরপর জানাল, চার পর্বের সিরিজের দুই পর্ব দেখেছে। বাকিটায় আগ্রহ পাচ্ছে না। সে খুবই নিরীহভাবে জানতে চাইল, এটা নিয়ে এত কেন হইচই হচ্ছে? ঘটনাটা যেন ওর কাছে খুবই ডালভাত মনে হয়েছে। বলল, ‘আমাদের স্কুলে তো এমন অনেক ঘটনাই ঘটে।’ কী ঘটে? আমার আগ্রহ দেখে সে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করল। এরপর বেশ কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা দিল। শুনে আমি অবাক হলাম—এমনও ঘটে!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করি ১৫ বছর ধরে; কিন্তু এই মাধ্যম নিয়ে আমি যে খুব সরগর, তা কিন্তু নয়। অথচ এটাই এখন এই কিশোরদের আরেক দুনিয়া, যার সঙ্গে বাস্তব জগতের বিশেষ পার্থক্য নেই। আমার ওই চাচাতো ভাই জানাল, সে তার এক সহপাঠীর সঙ্গে প্রায় পাঁচ বছর কথা বলে না। কেন জানেন? তার একটি ছবিতে পাঁচ বছর আগে নাকি সেই সহপাঠী ফেসবুকে একটি বাজে কমেন্ট করেছিল। কী কমেন্ট জানতে চাইলাম। বলল, ‘ও আমার ছবির নিচে লিখেছিলো “বলদ বলদ লাগছে।”’ এটুকু কমেন্টে তুই সিরিয়াস হয়ে গেলি? চাচাতো ভাই বিষ্ময়ের সঙ্গে বলল, ‘এমন একটা পাবলিক প্লেসে লিখল আর তুমি এইটুকু কমেন্ট বলছ!’
সময়ের ব্যবধানে আমরা যে ওদের আগের প্রজন্ম সেটি বুঝলাম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়ার এক কিশোরীর সঙ্গে কথা বলি প্রায় আধা ঘণ্টা। নবম শ্রেণির ওই ছাত্রী জানায়, অনলাইন আর অফলাইন তাদের কাছে বিশেষ কোনো ‘ম্যাটার’ করে না। স্কুলে প্রায় দুই বছর তার বান্ধরীরা তাকে বুলি করেছে ‘ড্যাডিস গার্ল’ বলে। কেন ড্যাডিস গার্ল বলত, জানতে চাইলে ওই ছাত্রী জানায়, ‘বাবা আমাকে সব সময় স্কুলে দিতে আসেন। কোথাও অনুষ্ঠান থাকলেও বাবাই নিয়ে যান। আমিও কোনো কিছু হলে আগে বাবাকে শেয়ার করি। বন্ধুদের সঙ্গে থাকার সময় স্বাভাবিকভাবেই বাবার কথা বারবার ওঠে। তাই ওরা আমার এই নাম দেয়। নিজে নিজে কষ্ট পেলেও অনেক দিন সেটি চেপে রেখেছিলাম; কিন্তু বন্ধুদের মেসেঞ্জার গ্রুপে আমার এক বান্ধবী বাবার ছবির সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে খুবই নোংরাভাবে ড্যাডিস গার্ল বলে বুলি করে। এরপর আর আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। প্রায় এক মাস স্কুলে যাইনি। ওদের সঙ্গে এরপর থেকে মেশা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। চলতি বছর ওই স্কুলটাই বদলে ফেলেছি।’
এখন এমন অনেক মিম, স্টিকার বা আলাদা শব্দ আছে যা দিয়ে পুরো একটি বাক্য প্রকাশ করে ফেলেন কিশোর–তরুণ, বিশেষ করে জেন–জিরা। এই স্টিকার বা ইমোজি দিয়েও চলে বুলিং। অনলাইন বা অফলাইন এই দুই জগৎই কিশোরদের কাছে এক। তাই সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে একসময় বকাবকি করে বা শারীরিকভাবে আঘাত করে যে বুলিং করার চল ছিল, এখন যেন সেটি অনলাইনে এসে ঠেকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট রাউফুন নাহার বলেন, ‘কিশোর–কিশোরীরা ভার্চু৵য়াল বুলিং নিয়ে বেশি সোচ্চার। কারণ, সেখানে এক্সপোজড হওয়ার শঙ্কা বেশি। বুলিং তো সবখানেই সমান। বাস্তব জীবনে ঘটুক আর ভার্চু৵য়ালি, কোনোটাকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই; বরং সরাসরি বুলি করলে যে কজন মানুষ সেটি জানতেন, অনলাইনে ঘটলে সেই সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এমনকি নিজের স্কুল বা এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে সেটি প্রসারিত হয়ে পড়ে বড় পরিসরে।’
নিজেকে নিরাপদ রাখতে তাই এই কাউন্সেলরের পরামর্শ হলো—যারা বুলি করে তারা সাধারণত ভিকটিমের দুর্বল দিক খুঁজে নিয়ে ভিকটিমের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে। এ সময় এলোমেলো প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ, বুলি করা ব্যক্তির এলোমেলো প্রতিক্রিয়া উত্ত৵ক্তকারীদের আরও উৎসাহী করতে পারে। তাই অভিভাবক বা শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে সঠিকভাবে বুলিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। একই সঙ্গে অনলাইন বুলিং ঠেকাতে কিশোরদের স্ক্রিনটাইম কমাতে হবে।