কেমোথেরাপির সময়ও রোজ অফিস করেছেন রুনামা

বায়োপসি পরীক্ষায় জানা গেল, রুনামা আমীন খানের শরীরে ক্যানসার বাসা বেঁধেছেছবি: রুনামা আমীন খানের সৌজন্যে

২০২৩ সালের এপ্রিলে স্তনে অস্বাভাবিক কিছু একটা অনুভব করলেন রুনামা আমীন খান। চাকরি, সংসার আর দাম্পত্য–সংকটের কারণে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো মনের অবস্থা তখন তাঁর ছিল না। রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ‘ও লেভেল কো–অর্ডিনেটর’ রুনামা। দুই কন্যাসন্তানের মা। মে মাসের শেষ নাগাদ তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়, বাবার বাড়ি চলে যান তিনি। তখনকার মতো বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।

জুন মাসে আবারও স্তনে অস্বাভাবিকতা অনুভব করলেন রুনামা। বিষয়টি এবার বোন নওরীন আমীন খান এবং ভাই এফ এম মনিরুজ্জামান খানকে জানালেন। তাঁরা দুজনই চিকিৎসক। দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হলো। শুরু হলো ওষুধ গ্রহণ। করছি করব করে আলট্রাসনোগ্রামটা আর করানো হয়নি। তবে মাঝেমধে৵ ব্যথা হতো।

শেষে মায়ের পরামর্শে আবার গেলেন চিকিৎসকের কাছে। সেবার আলট্রাসনোগ্রাম ও এফএনএসি পরীক্ষা করা হলো। রিপোর্ট দেখে রুনামার ভাই বললেন, বায়োপসি করাতে হবে। সেই পরীক্ষায় জানা গেল, রুনামার স্তনে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে।

তবে মন ভাঙেনি

ক্যানসারের মাস দুয়েক আগে ১৮ বছরের সংসার ভেঙে যায় রুনামার, তবে তিনি ভেঙে পড়েননি
ছবি: রুনামা আমীন খানের সৌজন্যে

তখন জুলাই মাস। মাস দুয়েক হয় ১৮ বছরের সংসার ভেঙেছে। মন যা ভাঙার তখনই ভেঙেছে। ক্যানসারের কারণে নতুন করে আর ভাঙেনি। চিকিৎসকদের পরামর্শমতো সব পরীক্ষাই করালেন। শল্যচিকিৎসা করালেন বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে। কেমোথেরাপি আর রেডিওথেরাপি দেওয়া হলো স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডে। চিকিৎসার পুরোটা সময় অবশ্য ক্যানসারের ধাক্কাটা টের পেয়েছেন তিনি।

বয়স্ক মা-বাবা সঙ্গে আসতে চাইতেন, নিষেধ করতেন রুনামা। তবে বড় মেয়ে শল্যচিকিৎসার সময় পাশে থেকেছে। পরে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সে–ও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর ছোট মেয়ে তো অনেক ছোট। রুনামার বোন তখন কাতারে থাকতেন। তাই পাশে থেকে ভরসা দেওয়ার মতো একজন মানুষই ছিলেন—ভাই।

নিজের পেশাগত দায়িত্ব, স্নাতকোত্তরের পড়ালেখা, সব সামলে যতটা পেরেছেন রুনামার পাশে থেকেছেন। কেমোথেরাপির শুরুতে টিউমারে বসানোর জন্য বিশেষায়িত চিপ জোগাড় করে দিয়েছেন মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে।

রেডিওথেরাপির সময় অবশ্য ছোট মেয়েই সঙ্গে যেত। অপেক্ষা করত বাইরে। রুনামার এই জার্নিতে ক্যানসার রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অরুনাংশু দাস সাহস দিয়েছেন সব সময়।

আরও পড়ুন

লড়াইয়ের ভেতর লড়াই

শুরুতে কেমোথেরাপির কষ্টটা সহ্য হচ্ছিল না। চুল, ভ্রু ও চোখের পাপড়ি পড়ে যাওয়ার পর আয়নায় নিজেকে চেনাই ছিল কঠিন। ছোটবেলায় একটু আঙুল কাটলে বাড়ি তোলপাড় করা রুনামা সেই সব কষ্ট সামলেছেন। ২১ দিন পরপর কেমোথেরাপি নিতেন বৃহস্পতিবার। সারা সপ্তাহ স্কুলের দায়িত্ব পালন করতেন।

রুনামা বলেন, ‘নিজের আর্থিক শক্তিটা হারাতে চাইনি। দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি থাকি। চেয়েছিলাম, ক্যানসারের ব্যয়বহুল চিকিৎসাটা যেন মা–বাবার ওপর বাড়তি চাপ হয়ে না দাঁড়ায়। কেমোথেরাপির জন্য আমার এক দিনও ছুটি না নেওয়ার বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষের নজর এড়ায়নি। অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও সহকর্মীরা সমর্থন দিয়েছেন সব সময়, এখনো দিচ্ছেন। আমার প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’

রুনামা অনলাইনভিত্তিক গয়নার দোকান ‘স্টোনস অ্যান্ড স্টিচেস’–এর স্বত্বাধিকারী। ২০১৯ সাল থেকে তাঁর নকশায় গয়না গড়ছেন কারিগরেরা। সৃজনশীলতার এই জায়গাটা তিনি এখনো ধরে রেখেছেন। ২০২৪ সালে শেষ হয় তাঁর ক্যানসারের চিকিৎসা।

এর পর থেকে যেকোনো ক্যানসার রোগীকে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করেন। পুরুষ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে অনেক নারীর মধে৵ এখনো দ্বিধা কাজ করে। তা থেকে বেরিয়ে নিঃসংকোচে নিজের সুস্থতাকেই প্রাধান্য দিতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন রুনামা।

আরও পড়ুন